বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ ১১ অঙ্গীকার

নৌকায় ভোট দিন শান্তি ও সমৃদ্ধি দেব, ইশতেহার ঘোষণায় শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ ১১ অঙ্গীকার

দ্রব্যমূল্য সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিসহ ১১টি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে গতকাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ইশতেহার ঘোষণা করেন।

১০০ পৃষ্ঠার পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত ইশতেহারের চুম্বক অংশ পাঠ করেন টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী। এ সময় আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশবাসীকে আবারও নৌকায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধি দেব। জনগণের অবিচল আস্থাই আওয়ামী লীগের শক্তি। এদেশের জনগণের প্রতি আমাদের রয়েছে অগাধ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে’ এবং ২০১৮ সালের ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আমরা আমাদের নির্বাচনি অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করে চলেছি। এবারও চারদিকে আওয়ামী লীগের নৌকার পক্ষে গণজোয়ার উঠেছে। এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা, ডিজিটাল, পরমাণু ও স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ- সবই সম্ভব হয়েছে নৌকায় ভোট দিয়ে। আমাদের আহ্বান, সব ভেদাভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে আপনারা হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নৌকা, বঙ্গবন্ধুর নৌকা, আওয়ামী লীগের নৌকার পক্ষে রায় দিন। বিগত ১৫ বছরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখুন। এটা প্রমাণিত যে, অব্যাহত উন্নয়নের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রাখা দরকার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যের শুরুতে সরকারের অর্জনগুলো তুলে ধরেন। মাথাপিছু আয়, জিডিপি ও বাজেটের আকার, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা খাতে সরকারের অর্জনগুলো তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে ইশতেহার কমিটির প্রধান ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আবদুর রাজ্জাক সূচনা বক্তব্য দেন। এরপর বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দলের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, শিক্ষাবিদ, সিনিয়র সাংবাদিক, ইমাম, শিক্ষার্থী, কৃষক, হকার, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, বিদেশি কূটনৈতিক ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইশতেহার ঘোষণার আগে সরকারের উন্নয়নচিত্র এবং বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনার জীবনী নিয়ে দুটি ভিডিও ডকুমেন্ট দেখানো হয়।  আওয়ামী লীগের এবারের ইশতেহারের স্লোগান ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। এই ইশতেহারে ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘সাথে আছি  থাকবো কাল, শেখ হাসিনাই ধরবে হাল’। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘দিনবদলের সনদ’ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ছিল দলটির। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির ইশতেহারের শিরোনাম ছিল, ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। আর সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইশতেহারের শিরোনাম ছিল, ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। এবার নির্বাচনে বিজয়ী হলে যে ১১টি বিষয়ে আওয়ামী লীগ অগ্রাধিকার দেবে, সেগুলো হলো- দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা, লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো, নিম্নআয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা, সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।  ইশতেহারে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করছি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৫ বছরের সরকার পরিচালনার পথপরিক্রমায় যা কিছু ভুলত্রুটি, তার দায়ভার আমাদের। সাফল্যের কৃতিত্ব আপনাদের। আমাদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমরা কথা দিচ্ছি, অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মকান্ড পরিচালনা করব। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিতে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে দেশ। এ উত্তরণ যেমন একদিকে সম্মানের, অন্যদিকে বিশাল চ্যালেঞ্জেরও। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতা থাকতে হবে। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে।  শেখ হাসিনা বলেন, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়, মাতৃভূমির স্বাধীনতা থেকে শুরু করে এ দেশের যা কিছু মহৎ অর্জন, তা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠিত হবে। 

১০০ পৃষ্ঠার পুস্তিকার শেষে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এটা এখন দিব্যলোকের মতো স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে জনগণ দৃশ্যমান উন্নয়ন পায়। আমরা শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, জনগণের কল্যাণে অব্যাহতভাবে কাজে বিশ্বাসী। আমাদের এবারের অঙ্গীকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের প্রতিশ্রুতি, ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ অনুযায়ী প্রতিটি গ্রামে শহরের আধুনিক সুবিধাদি আরও ব্যাপকভাবে পৌঁছে যাবে। কৃষি যান্ত্রিকায়নের ফলে শ্রমের কষ্ট লাঘব হবে, কৃষকের খরচ কমবে, উৎপাদন ও লাভ বাড়বে। কৃষিকে আমরা একটি লাভজনক ও সম্মানের পেশা হিসেবে গড়ে তুলব। আমরা বিভিন্ন পেশাজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণে বিনিয়োগ বাড়াব। তিনি বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, অগ্নিসন্ত্রাস, অবরোধ ও বিশৃঙ্খলার রাজনীতি শুধু ধ্বংসই ডেকে আনে, উন্নয়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত করে। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, সাম্প্রতিক সময়ে কীভাবে উপর্যুপরি গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এবং জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে স্বাভাবিক জীবনযাপন ও উন্নয়নকে বিঘিœত করেছে। আমরা এসবের অবসান চাই, চাই গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন। আমরা মাদক, দুর্নীতি ও অবিচার নির্মূল করে সমাজের সব পর্যায়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করব। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমার আকাক্সক্ষা ছিল, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করা। আপনাদের সমর্থন পেয়ে তা সফল করতে সমর্থ হয়েছি। আমি আশা করব, আবারও আপনাদের সমর্থন নিয়ে দেশ ও মানুষের সেবা করার সুযোগ পাব। তিনি বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার নির্বাচন, অনুন্নয়ন ও পশ্চাৎপদতার বিপরীতে ধারাবাহিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নির্বাচন। আমাদের নিরলস পরিশ্রম ও উন্নয়ন অর্জনগুলো সঠিক মূল্যায়ন করে দেশ ও জাতির অব্যাহত কল্যাণ, শান্তি-সংহতি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২৮ সাল পর্যন্ত আগামী পাঁচ বছরের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষে আপনাদের মহান রায় প্রার্থনা করছি। লাখো লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নলালিত সোনার বাংলা বিনির্মাণের অভিযাত্রায় আবারও নৌকার পক্ষে সমর্থন চাই, আপনাদের মূল্যবান ভোট চাই। শেখ হাসিনা বলেন, নাগরিকমুখী, কল্যাণমূলক দক্ষ ও স্মার্ট প্রশাসন গড়ার মাধ্যমে জনগণকে উন্নত সেবা দেওয়া এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ অঙ্গীকারবদ্ধ। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের মাধ্যমে দক্ষ, উদ্যোগী, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও দুর্নীতিমুক্ত দেশপ্রেমিক প্রশাসন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে সরকারের তথ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, উদ্যোগী ও জনবান্ধব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক দেওয়া হচ্ছে। সততা ও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারীদের পুরস্কার ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।  তার সরকার সমাজ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। বর্তমান সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য পাঠক্রমে এর কুফল সংযোজন করে ছোটবেলা থেকেই তাদের সচেতন করে গড়ে তোলা হবে।

যা বলি তা বাস্তবায়ন করি : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কথামালার রাজনীতি নয়, তাঁর দল যে কথা বলে সে কথা বাস্তবায়ন করে। আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাঙালিদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মাথাপিছু আয়, জিডিপি ও বাজেটের আকার, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা খাতে সরকারের অর্জনগুলো তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সব সময়ই যে আমরা শতভাগ সফল হয়েছি, এমন দাবি করব না। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কথামালার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আমরা যা বলি, তা বাস্তবায়ন করি। শেখ হাসিনা আরও বলেন, নির্বাচন এলেই মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং উন্নয়নবিরোধী একটি চক্র ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নির্বাচনে কূটকৌশল অবলম্বন বা কারচুপির মাধ্যমে কিংবা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে তারা আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে। সফল না হলে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিশোধ স্পৃহায়। অগ্নিসন্ত্রাস, যানবাহন পোড়ানো, বোমাবাজি, নাশকতা বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে ভীতি-সন্ত্রস্ত করে ঘরবন্দি করতে চায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার ওপর এবার তারা বিদেশ থেকেও কলকাঠি নাড়ছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশ যখন আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে অব্যাহতভাবে গণতান্ত্রিক-সাংবিধানিক ও উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে অগ্রসর হচ্ছে, তখন জাতির জন্য সাংবিধানিক ধারায় এই নির্বাচন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সুষ্ঠু অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা আজ সময়ের দাবি। ভোট হচ্ছে আপনাদের পবিত্র আমানত, অধিকার। আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্বাস করে যে, আপনারাই সব ক্ষমতার উৎস। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন এক অভূতপূর্ব উন্নয়নের বিস্ময়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এক উজ্জ্বল রোল মডেল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার মানসে আমাদের অব্যাহত অগ্রযাত্রায় সাফল্যের ১৫ বছর সগৌরবে পূর্ণ হতে চলেছে। জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। খেতখামার, কলকারখানা, গ্রাম-শহর, নগর-বন্দর সর্বত্রই দৃশ্যমান উন্নয়নের ছোঁয়া। কৃষির বিস্ময়কর রূপান্তর ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে সব মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি, দেশ থেকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর করতে পেরেছি। কৃষি, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ প্রতিটি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থান বাড়িয়েছি। এর ফলে আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব দরবারে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সমর্থ হয়েছি। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে’ এবং ২০১৮ সালের ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আমরা আমাদের নির্বাচনি অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়ন করে চলেছি। বিশেষ করে, তৃতীয় মেয়াদে সর্বগ্রাসী করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও আমরা অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছি, সফলভাবে দ্রুততম সময়ে করোনা অতিমারি প্রতিরোধ করেছি এবং খাদ্যানসহ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছি। তাই আমরা নিজেদের অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মতো বিশাল অবকাঠামো গড়ে তোলার সাহস দেখাতে পেরেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল, বর্ধিত বিমান ও নৌবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দরসহ প্রতিশ্রুতি মেগা প্রকল্পগুলো। এসব অত্যাধুনিক অবকাঠামোর বাস্তবায়ন উন্নয়নের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে গ্রামপর্যায়ে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ও অনলাইনসংযোগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি। আমাদের লক্ষ্য এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ টেকসই সমাজ গড়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ করা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নারী ও তারুণ্যের বিকাশ এবং তাদের অমিত শক্তিকে পুরোপুরি উৎপাদনশীল কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর। আমরা গর্ব করে বলতে চাই যে, সমগ্র দেশে ভৌত অবকাঠামো, নিবিড় যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন সম্প্রসারিত হয়েছে। সেই সঙ্গে ইতোমধ্যেই কর্মসংস্থানমুখী শতাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইপিজেড ও হাইটেক পার্ক নির্মিত হওয়ার ফলে বহু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হচ্ছে। এটা খুব উৎসাহব্যঞ্জক যে আমরা এসব যুগান্তকারী অবকাঠামো ও শিল্পায়নের প্রাথমিক পর্যায়েই আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছি। আগামীতে এসব উদ্যোগ পূর্ণ উদ্যমে চালু হওয়ার পর আরও বহুমাত্রিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। বিদেশি ভাষা শিক্ষাসহ যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে তরুণদের জন্য আমরা বিদেশেও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বের করছি। অমিত সম্ভাবনার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বিকাশের সহায়ক পরিবেশ ও অবকাঠামো সৃষ্টির মাধ্যমে তরুণদের নানামুখী আয়ের পথ সৃজন করা হচ্ছে।

তারা বিদেশ থেকেও কলকাঠি নাড়ছে : নাম উল্লেখ না করে বিরোধী দল বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস, যানবাহন পোড়ানো, বোমাবাজি, নাশকতা বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে ঘরবন্দি করতে চায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার ওপর এবার তারা বিদেশ থেকেও কলকাঠি নাড়ছে। শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন এলেই মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং উন্নয়নবিরোধী একটি চক্র ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নির্বাচনে কূটকৌশল অবলম্বন বা কারচুপির মাধ্যমে কিংবা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে তারা আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে। সফল না হলে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিশোধস্পৃহায়।  তিনি বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট পাবে না এটা বুঝতে পেরে আগে থেকে এবার তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে। হরতাল-অবরোধের নামে যানবাহন পোড়ানো, মানুষ হত্যা, রেললাইন উপড়ে ফেলাসহ বিভিন্ন নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। মা ও শিশুর অগ্নিদগ্ধ লাশ সবার বিবেককে প্রচ-ভাবে নাড়া দিয়েছে। এ ধরনের হীন কাজ আর সহ্য করা যায় না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, জনগণের সাড়া না পেয়ে ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে এসব নাশকতা চালিয়ে জানমালের ক্ষতি করছে। সন্ত্রাস করে নির্বাচন বানচাল করার স্বপ্ন-সাধ কোনো দিনই তাদের পূরণ হতে দেবে না এ দেশের জনগণ। সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৩-১৬ সময়ে যেমন আপনারা ওদের প্রতিহত করেছিলেন; আসুন, এবারও সম্মিলিতভাবে ওদের প্রতিহত করি।

স্বাধীনতাবিরোধী, উন্নয়নবিরোধী এই শকুনের দল আর কোনো দিন যাতে বিষময় দন্ত-নখর বসিয়ে বাংলাদেশকে ক্ষতবিক্ষত করতে না পারে, আসুন, এই বিজয়ের মাসে এ শপথ নিই।

ছোটখাটো অভিঘাত আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ছোটখাটো অভিঘাত আজ আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। আজকের বাংলাদেশ দারিদ্র্যক্লিষ্ট, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। সম্ভাবনার হাতছানি দেওয়া দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা দুরন্ত বাংলাদেশ। ছোটখাটো অভিঘাত আজ আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। করোনা মহামারিসহ নানা অভিঘাত মোকাবিলা করে সেই প্রমাণ আমরা রেখেছি।

নির্বাচনি ইশতেহারে আরও যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে : আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত, সাংবাদিকদের জন্য দশম ওয়েজ বোর্ড, সাংবাদিকগণ যাতে নির্যাতন, ভয়ভীতি-হুমকি, মিথ্যা মামলার সম্মুখীন না হন তার ব্যবস্থা করা হবে। ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তা ও তথ্য সংরক্ষণ করা হবে এবং অপব্যবহার রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব বিভাজন স্পষ্ট করা হবে, ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা, গ্রামে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, দেশের উন্নয়নে তরুণ ও যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করা, কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখবে, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাবে। সর্বজনীন পেনশনে সবাইকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা, শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়বে, মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে যথাযথ শিক্ষা পাঠক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের ইউনিক হেলথ আইডি প্রদান করা হবে। সব ধর্মের শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন নিশ্চিত করা হবে। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাকে জনপ্রিয় করে তোলা হবে। নারী শ্রমিকদের প্রতি ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অসঙ্গতি দূর অব্যাহত থাকবে। জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে।  এনজিওর জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ করা হবে।

এক ডজন খাতে শূন্য থেকে শুরু করে চমক আওয়ামী লীগের : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন খাতভিত্তিক নতুন প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অন্তত এক ডজন খাতে শূন্য থেকে শুরু করে চমক দেখানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে দলটির ইশতেহারে। এতে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার সময় শূন্য থাকা ১২টি খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদ শেষে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

সে অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের আমলে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত জেলা হয়েছে ৩২টি, ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত উপজেলার সংখ্যা ৩৯৪টি। ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ৮ হাজার ৯৭২টি। ইউনিয়ন পর্যায়ে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৬০০টি ইউনিয়নে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোন ব্র্যান্ডের সংখ্যা এখন ১৫টি। হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এবং শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার করা হয়েছে ১০৯টি। ফ্যামিলি কার্ড ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তাপ্রাপ্ত উপকারভোগীর (টিসিবি কর্তৃক প্রদত্ত) সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৫ কোটিতে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা বর্তমানে ৮৪ লাখ। কৃষকদের প্রদানকৃত কৃষি কার্ডের আওতায় এসেছেন ২ কোটি ৬২ লাখ কৃষক। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ৫১ লাখে উন্নীত হয়েছে। ‘বর্গা চাষিদের জন্য কৃষিঋণ’ কর্মসূচির আওতায় দেশে এখন ২৮ লাখ বর্গা চাষি রয়েছেন। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুবিধাভোগী পৌঁছেছে ৮ কোটি ৫০ লাখে।

সর্বশেষ খবর