শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ড. ইউনূসের জেল পরে জামিন

♦ শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ♦ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ড ♦ জামিন পেয়েছেন আপিলের শর্তে ♦ দোষ না করেও শাস্তি পেলাম : ড. ইউনূস

নিজস্ব প্রতিবেদক

ড. ইউনূসের জেল পরে জামিন

আদালত প্রাঙ্গণে গতকাল ড. মুহাম্মদ ইউনূস -জয়ীতা রায়

শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে ৩০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। এ জরিমানা অনাদায়ে তাঁকে আরও ১৫ দিন কারাভোগ করতে হবে। গতকাল রাজধানীর বিজয়নগরে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। তবে রায় ঘোষণার ৫ মিনিটের মধ্যেই ড. ইউনূসসহ বাকি আসামিদের জামিন দেন আদালত।

এ মামলায় অন্য তিন আসামি হলেন গ্রামীণ টেলিকমের এমডি আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। তাঁদেরও একই সাজা দেন আদালত। পরে আপিল করার শর্তে ও ৫ হাজার টাকা বন্ডে তাঁদের এক মাসের জামিন দেওয়া হয়। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ড. ইউনূস বলেন, ‘যে দোষ করিনি সেটায়ই শাস্তি পেলাম।’ এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী। অন্যদিকে কলকারখানা অধিদফতরের আইনজীবী বলেন, ‘তাঁরা শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন, এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।’ আদালতে ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ছাড়াও রায়ের সময় উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, তাঁর স্ত্রী অ্যাকটিভিস্ট রেহনুমা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক আসিফ নজরুল ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

এর আগে দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে ড. ইউনূসসহ চার আসামি আদালতে হাজির হন। দুপুর সোয়া ২টার দিকে ৮৪ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, আসামিপক্ষ ১ নম্বর আসামির বিষয়ে প্রশংসাসূচক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। যেখানে তাঁকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব বলা হয়েছে। কিন্তু এ আদালতে নোবেলজয়ী ইউনূসের বিচার হচ্ছে না, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচার হচ্ছে। এ সময় আদালত বলেন, ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

যে দোষ করিনি সেটায়ই শাস্তি পেলাম : রায়ের পর নিজের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ড. ইউনূস বলেন, ‘যে দোষ করিনি সেটার শাস্তি পেলাম। এটাকে যদি ন্যায়বিচার বলতে চান, বলতে পারেন।’ ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘বছরের প্রথম দিন আদালতে এসে মনটা ভরে গেল। এখানে অনেকে এসেছিলেন রায় শোনার জন্য। আমার কী অবস্থা হয় দেখার জন্য। আমার অনেক বন্ধুবান্ধবকে এখানে পেয়ে গেলাম, যাদের সঙ্গে বহুদিন দেখা হয়নি।’

যা বললেন আইনজীবীরা : রায় ঘোষণার পর ড. ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন এ রায়কে নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শ্রম আদালতের এ রায় অপূর্ণাঙ্গ। ড. ইউনূস আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাননি। এ রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।

রায়ের পর কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদফতরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, আদালত তাঁদের শোকজ করেছেন, তাঁরা জবাব দিয়েছেন, কিন্তু আদালত তাঁদের জবাব সন্তোষজনক মনে করেননি। তাঁদের যেসব ত্রুটি ছিল তা তাঁরা সংশোধন করেননি। বরং সন্দেহাতীতভাবে আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে তাঁরা শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন। বাদীপক্ষের চারজন সাক্ষী ও কিছু ডকুমেন্টের মাধ্যমে প্রমাণও করেছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নোবেলজয়ী হিসেবে নয়, প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে তাঁর বিচার হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ওনারা শুধু বলেন ড. ইউনূস নোবেলজয়ী। নোবেলজয়ী হিসেবে তো তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। এখানে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে লেবার ল ভায়োলেট হয়েছে; যা আদালত আমলে নিয়েছেন। কিছু হলেই তাঁরা বলেন তিনি নোবেলজয়ী। নোবেলজয়ী হলেও তো আদালত ও আইনের ঊর্ধ্বে নন।’

প্রতিক্রিয়া : রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ড. ইউনূসের শুভাকাক্সক্ষী অধিকারকর্মীরা। নিজের প্রতিক্রিয়ায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার কর্মী আইরিন খান বলেন, ‘এ সাজার রায়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের কোনো অসম্মান হবে না। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তাঁর সম্মান অটুট থাকবে। বরং তাঁর বিরুদ্ধে রায়ের ফলে দেশেরই অসম্মান হবে, দেশের বিচারব্যবস্থার অসম্মান হবে।’

রায়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখানে সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে এসেছি স্যারের প্রতি সংহতি জানাতে। আমরা মনে করি, ড. ইউনূসের বিচার চলাকালে এবং এর আগে ক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উনার বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেভাবে শ্রম আদালত বসেছেন, অস্বাভাবিক দ্রুততায় রায় হয়েছে। আমাদের সন্দেহ আছে, এটা ন্যায়বিচার হয়েছে কি না।’

ফিরে দেখা : ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মামলাটি করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর। শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় গত ৬ জুন ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। অভিযোগ গঠনের আদেশ বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছিলেন ড. ইউনূস ও অন্যরা। আপিল বিভাগ গত ২০ আগস্ট সে আবেদন চূড়ান্তভাবে খারিজ করে দেন। এরপর ২২ আগস্ট শ্রম আদালতে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়, যা শেষ হয় গত ৯ নভেম্বর। এতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের চার কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। ২৪ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ১ জানুয়ারি দিন ঠিক করে দেন আদালত। মামলায় অভিযোগ আনা হয় যে শ্রম আইন, ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হলেও তাদের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি দেওয়া, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া হয় না। মামলায় আরও অভিযোগ আনা হয়, গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি এবং লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেওয়া হয় না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর