বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভোটের হুমকি ৫২ আসনে

অস্ত্রবাজদের তৎপরতায় দুই পক্ষই মুখোমুখি। ইসিতে অভিযোগের স্তূপ, ৭ জানুয়ারি সংঘাতের শঙ্কা, কোথাও কোথাও আলোচনায় প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫২ আসনে হুমকি রয়েছে। এসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী-সন্ত্রাসীদের জড়ো করার অভিযোগ তুলছেন। তারা শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন, লিখিতভাবেও নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দাখিল করছেন। ইসিতে অভিযোগের স্তূপ জমা পড়ছে। অভিযোগে তারা ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতার শঙ্কা করেছেন। কোনো কোনো এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলছেন। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী এসপি ও রূপগঞ্জের ওসির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। এরা থাকলে ৭ জানুয়ারি ভোট সুষ্ঠু হবে না বলে তাদের অভিযোগ। জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আর মাত্র দুই দিন বাকি। নির্বাচনে প্রচার ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা, ক্যাম্প ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা থামছেই না। সর্বশেষ বরিশাল-২ আসনের বানারীপাড়ায় নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি হামলায় অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছে। এ এলাকায় অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাইয়াজুল হক রাজুর অভিযোগ, ‘বাইশারী গ্রামে তাঁর সমর্থকদের একটি মিছিলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সমর্থকরা হামলা ও গুলি চালান।’ স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, প্রশাসনের লোকজনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। প্রশাসনের যে পরিমাণ তৎপরতা দেখানো দরকার ছিল, তা দেখানো হয়নি। যে কারণে সংঘাত বেড়েই চলেছে। কুমিল্লার দেবিদ্বার, চৌদ্দগ্রাম, দাউদকান্দি, সদর, মুরাদনগর আসনে উত্তজনা বিরাজ করছে। ভোটের দিন রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব আসনে সেনাবাহিনী মোতায়েন চান প্রার্থীরা।

ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী ও তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গুন্ডাবাহিনী, সন্ত্রাসী বাহিনী, বোমা বাহিনী, হোন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ অস্ত্র যাদের কাছে রয়েছে, তাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও গ্রেফতার করতে হবে। এ নির্বাচনের দিকে সবাই তাকিয়ে। কোনো কারণে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে দেশের সম্মান খাটো হয়ে যাবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অর্জন নষ্ট হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর কথায়, সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাসে আমরা ভোটে অংশ নিয়েছি। আশা করি সুষ্ঠু ভোট হবে। কোনো কারণে সুষ্ঠু ভোট না হলে বিশ্বে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হবে।’ রাজশাহীর দুটি আসন চরম ঝুঁকিপর্ণ মনে করছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা। রংপুরের ছয়টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিরপেক্ষ ভোটের দাবি তুলেছেন। সুনামগঞ্জ সদর আসনের বর্তমান এমপি ও লাঙল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছু কিছু জায়গায় জাতীয় পার্টির কর্মী-সমর্থকদের নির্বাচনি প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। হুমকিধমকি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এ আসনে কিছু কিছু জায়গায় আগের রাতে ব্যালট বাক্স পাঠানোর কথা শুনছি। এটাই সুষ্ঠু ভোটের শঙ্কা। কারণ আমার প্রতিপক্ষ সাবেক আমলা, কাজেই আগের রাতে ব্যালট পাঠিয়ে যেন সিল মেরে ভরে রাখা না হয়, সেজন্য ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানোর দাবি করছি। জনগণ সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারলে আমার বিজয় সুনিশ্চিত।’

ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে ব্যবসায়ী এ কে আজাদ চৌধুরী নিরপেক্ষ ভোটের দাবি জানিয়েছেন। ফরিদপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আরিফুর রহমান দোলনও সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। ফরিদপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জামাল হোসেন মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার প্রতিপক্ষ নৌকার প্রার্থী ভোট কাটার সব ধরনের আয়োজন শেষ করেছে। স্ষ্ঠুু ভোটের পরিবেশ দেখছি না। ইসির কাছে দাবি, সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক।’ চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হুইপ সামশুল হক চৌধুরী নির্বাচন উপলক্ষে এলাকায় সন্ত্রাসী-অস্ত্রবাজদের জড়ো করছেন। নির্বাচনের দিন প্রভাব ঘাটিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবেন। ইতোমধ্যে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা মহড়াও দিচ্ছে। সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভোটে হুমকি রয়েছে এমন ৫২ আসন চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরের চারটি আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে বলেছেন। কোনো ধরনের হুমকিধমকি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে বড় বাধা বলে মনে করেন তারা। একই ধরনের কথা জানা গেছে ময়মনসিংহের চারটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মুখে। জানা গেছে, ৩০০ আসনের মধ্যে নওগাঁ-২-এ স্বতন্ত্র প্রার্থী মারা যাওয়ায় সে আসনের ভোট গ্রহণ স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। সে কারণে ২৯৯টি আসনে ভোট হবে। এ আসনগুলোর অধিকাংশেই নৌকার সঙ্গে লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। টাঙ্গাইলের অধিকাংশ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। ঢাকা-৫ আসনে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচারে বাধা প্রদান, কেন্দ্র ভাঙচুর, হুমকিধমকির অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া তাঁর কর্মী-সমর্থকরা বলে বেড়াচ্ছেন, যেখানেই ভোট দিন, নৌকার ভোট হিসেবে যোগ করা হবে। ইসিসূত্র জানান, আচরণবিধি লঙ্ঘন থামছে না। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়ে অভিযোগের স্তূপ তৈরি হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫ শতাধিক আবদেন এসেছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে। এর মধ্যে দেড় শতাধিক অভিযোগ আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও দলীয় স্বতন্ত্রদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগও রয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ৫৮৯ প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শোকজের মুখে পড়েছেন। নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি গতকাল পর্যন্ত প্রার্থী ও সমর্থকদের ৫৮৯টি নোটিস করেছে। সবচেয়ে বেশি নোটিস করা হয়েছে ঢাকা অঞ্চলে। ঢাকায় নোটিসের সংখ্যা ১৩১ এবং রাজশাহী অঞ্চলে ১০৩টি। সুষ্ঠু নির্বাচনে ইসির করণীয় জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। এক প্রার্থীর ওপর অন্য প্রার্থীর যে হামলার ঘটনাগুলো ঘটছে, এটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কোনো বাধা নয়। তবে এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন। এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত যেসব কর্মকর্তা আছেন, রিটার্নিং অফিসার আছেন, ম্যাজিস্ট্রেট আছেন উনারা দেখবেন। অভিযোগ দিলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। সরকার একটা সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, নির্বাচন কমিশন তাদের দিকনির্দেশনা দেবে যাতে ভালো নির্বাচন হয়।’ সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘নির্বাচনি ক্যাম্পে আগুন, ভাঙচুর ও সহিংসতার ঘটনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো ইফেক্ট পড়ার কথা না। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন শতভাগ নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে নির্বাচন করছে। তবে সংঘাত যেন না ঘটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সে বিষয়ে আরও সজাগ থাকতে হবে। নইলে নির্বাচন কেন্দ্র করে বড় ধরনের সংঘাত ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

রূপগঞ্জে জড়ো হচ্ছে অস্ত্রধারীরা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর