শুক্রবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নৌকার ৯৩ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

নৌকার ৯৩ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোট প্রার্থীর ৯২ দশমিক ৮৩ শতাংশই কোটিপতি। ক্ষমতাসীন দলটির ২৬৫ প্রার্থীর বার্ষিক গড় আয় ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। গড় সম্পদমূল্য সাড়ে ২৮ কোটি টাকার বেশি। দলটির প্রার্থীদের ১৭০ জনই (৬৪ দশমিক ১৫ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। গতকাল এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পেয়েছে সংগঠনটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ১ হাজার ৯৪৫ জনের মোট বার্ষিক আয় ১ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। মোট সম্পদমূল্য ১৩ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি আয় ও সম্পদ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের। এরপর আয় ও সম্পদ বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। হলফনামা বিশ্লেষণ করে সংবাদ সম্মেলনে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ক্ষমতার সঙ্গে জাদুরকাঠি জড়িত। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের গড় আয়ের সঙ্গে অন্য সব প্রার্থীর গড় আয়ের বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে এবং দিন দিন এটি আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, যে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল, সেখানে প্রার্থীদের মধ্যে আয় বৈষম্য কম ছিল। একতরফা নির্বাচনে এ বৈষম্য বেড়ে যায়। কারণ, এসব নির্বাচনে যেনতেন প্রার্থী দিলেও জিততে সমস্যা হয় না। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালে আয় বৈষম্যের প্রবণতা প্রকট হতে শুরু করে। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের গড় আয় বাড়লেও অন্য সব প্রার্থীর সঙ্গে তাদের প্রার্থীদের আয়ের এ বৈষম্য কিছুটা কমে আসে। তখন দুই গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য ছিল ৬১ শতাংশ। ২০২৪ সালের নির্বাচনের হলফনামা অনুসারে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অন্য সব প্রার্থীর সঙ্গে পার্থক্য অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালে এ পার্থক্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫৯ শতাংশে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ী প্রার্থী ছিলেন প্রায় ৫২ শতাংশ। ৭ শতাংশ বেড়ে এবারের নির্বাচনে ব্যবসায়ী প্রার্থী প্রায় ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৬৫ প্রার্থীর মধ্যে ১৭০ জন (৬৪ দশমিক ১৫ শতাংশ), জাতীয় পার্টির ২৬২ প্রার্থীর মধ্যে ১৭৩ জন (৬৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ) এবং ৪৩৩ স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ব্যবসায়ী ৩০২ জন (৬৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ)। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে এবারের নির্বাচনে শত কোটি টাকার অধিক সম্পদশালী প্রার্থী আছেন ২৭ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সম্পদশালী হলেন, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী। তার সম্পদমূল্য ১৪৫৭ কোটি টাকা। তালিকার সর্বশেষ শত কোটির সম্পদশালী প্রার্থী ঢাকা-৯ আসনের আওয়ামী প্রার্থী সাবের হোসেন চৌধুরী। তার সম্পদমূল্য ১০৩ কোটি টাকা। তালিকার অন্যান্যরা হলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এ কে একরামুজ্জামান (৪৯৭ কোটি), কুমিল্লা-৮ আসনের নৌকার প্রার্থী আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন (৩৭২ কোটি), ঢাকা-১ আসনের আওয়ামী প্রার্থী সালমান ফজলুর রহমান (৩৫৩ কোটি), সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী প্রার্থী আবদুল মমিন মণ্ডল (৩৪২ কোটি), গাজীপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আলম আহমেদ (৩৩০ কোটি), চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী দিলীপ কুমার আগর ওয়ালা (৩১৭ কোটি), কুমিল্লা-৩ আসনের আওয়ামী প্রার্থী ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন (৩০৫ কোটি), নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী গোলাম মূর্তজা (২৭৭ কোটি), ঢাকা-৬ আসনের আওয়ামী প্রার্থী মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ((২৩৭ কোটি), নরসিংদী-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লা (১৯২ কোটি)।

প্রতিবেদনে শীর্ষ দশ ঋণগ্রস্ত প্রার্থীর তালিকাও করেছে সুজন। সবচেয়ে বেশি ঋণ আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এ কে একরামুজ্জামান। তার ঋণের পরিমাণ ২৩০১ কোটি টাকা। তালিকার দশম ব্যক্তি হলেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ রাজ্জাক খান। তার ঋণের পরিমাণ ৫০৬ কোটি টাকা। শীর্ষ ঋণগ্রস্তের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছেন চট্টগ্রাম-১০ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম (১৯৯৭ কোটি)। বাকিরা হলেন, গাইবান্ধা-৫ আসনের আওয়ামী প্রার্থী মাহমুদ হাসান (১২০৩ কোটি), নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী (৯৩৫ কোটি), যশোর-৩ আসনের আওয়ামী প্রার্থী কাজী নাবিল আহমেদ (৯১৯ কোটি), কুমিল্লা-৬ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী এয়ার আহমেদ সেলিম (৮৪৫ কোটি), জয়পুরহাট-২ আসনের আওয়ামী প্রার্থী আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন (৭৫৭ কোটি), ফেনী-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইশতিয়াক আহমেদ সৈকত (৫৫৫ কোটি), নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী এ কে এম সেলিম ওসমান (৫১০ কোটি)। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ৯১৫ জন (৪৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ) আয়কর দেন। এর মধ্যে লাখ টাকার ওপরে আয়কর দেন ৩৫২ জন।

সুজন জানায়, কোটি টাকার অধিক আয়কারী প্রার্থী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বেশি। দলটির ৯৮ প্রার্থীর (৪৫.০৩%) বার্ষিক আয় কোটি টাকার ওপরে। এরপর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ৫৬ জন প্রার্থী (১২.৯৩%) এবং জাতীয় পার্টির ১০ জনের (৩.৮২%) বার্ষিক আয় কোটির টাকার ওপরে।

শীর্ষ দশ উপার্জনকারীর তালিকায়ও এগিয়ে আছেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের গোলাম দস্তগীর গাজী। তার বার্ষিক আয় ৮৩ কোটি টাকা। বাকি নয়জন হলেন, কুমিল্লা-৮ আসনের আওয়ামী প্রার্থী আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিন (৭০ কোটি), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের আওয়ামী প্রার্থী এস এ কে একরামুজ্জামান (৫৪ কোটি), নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী গোলাম মূর্তজা (৫১ কোটি), ঢাকা-১ এর সালমান এফ রহমান (৫০ কোটি), ঝিনাইদহ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসের শাহরিয়ার জাহেদী (১৯ কোটি), বরিশাল-৩ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপু (১৮ কোটি), নরসিংদী-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লা (১৬ কোটি), ঢাকা-১৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী খসরু চৌধুরী (১৬ কোটি) এবং যশোর-৩ আসনের আওয়ামী প্রার্থী কাজী নাবিল আহামেদ (১৪ কোটি)। নগদ টাকার পরিমাণের ভিত্তিতে শীর্ষ দশ প্রার্থীর তালিকা করেছে সুজন। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নগদ অর্থ আছে সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী প্রার্থী আবদুল মমিন মণ্ডলের। তার নগদ টাকার পরিমাণ ৪৭ কোটি। এরপর আছেন পটুয়াখালী-১ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার (২৬ কোটি), নোয়াখালী-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান ভূইয়া (২৬ কোটি), কুমিল্লা-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মজিদ (২৩ কোটি), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এ কে একরামুজ্জামান (২৩ কোটি), রাজশাহী-৬ আসনের আওয়ামী প্রার্থী শাহরিয়ার আলম (২১ কোটি), চট্টগ্রাম-১০ আসনের তৃণমূল বিএনপির ফেরদাউস বশির (১৯ কোটি), কুমিল্লা-৩ আসনের ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন (১৬ কোটি), ঢাকা-৭ আসনের আওয়ামী প্রার্থী সোলায়মান সেলিম (১১ কোটি) এবং মানিকগঞ্জ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ (১১ কোটি)। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন। তিনি বলেন, জনগণ এখন সংসদ থেকে কিছু আশা করে না। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তো জিতেই গেল। তবে এই নির্বাচন কেউ মেনে নেবে না। টানেলের শেষে নিশ্চয়ই আলো আসবে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ভালো নির্বাচন হবে, এই আশা করি। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন পাঠ করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। আরও বক্তব্য দেন আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, প্রার্থীদের সম্পদের তথ্যের ক্ষেত্রে দুদক চাইলে দুদক আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তির ১৫ বছরের সম্পদের হিসাব চাইতে পারে। সম্পদ ও আয়ের কোনো গরমিল পেলে ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা সবাই জানি দুদক প্রার্থীদের ব্যাপারে এটি করবে না। প্রার্থীদের হলফনামায় অস্বচ্ছতার কথা উল্লেখ করে কয়েকটি সুপারিশও করেছে সুজন। সুপারিশগুলো হলো- ফলাফলের গেজেট প্রকাশের আগেই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের হলফনামায় উল্লিখিত তথ্যসমূহের সঠিকতা যাচাই করে মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীদের ফলাফল বাতিল করা। হলফনামার ছকে পরিবর্তন আনা, বিশেষ করে সম্পদের তথ্য ছকে পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে অস্থাবর ও স্থাবর মূল্য উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা এবং বর্তমান বাজারমূল্য উল্লেখের বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর