দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট উৎসব আজ। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে ২৯৯ আসনে। নওগাঁ-২ আসনের একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় সেখানে পরে ভোট হবে। ভোটের মাঠে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে মোতায়েন থাকছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য।
কারচুপি ঠেকাতে আজ ভোটের দিন সকালে ৩৯ হাজার ৬১ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠাবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর ২ হাজার ৯৬৪ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছে গেছে গতকালই। এ ছাড়া শুক্রবারও বেশ কিছু দুর্গম কেন্দ্রে হেলিকপ্টারযোগে নির্বাচনি সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে।
ভোটের লড়াইয়ে আছেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮ দলের ১ হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী। এর মধ্যে স্বতন্ত্র ৪৩৭ জন। ভোট উৎসব পালনে প্রস্তুত প্রার্থী ও ভোটাররা। ভোট ঘিরে দেশজুড়েই টানটান উত্তেজনা আছে। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নির্বাচনি মাঠে রয়েছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে সবকিছু কঠোরভাবে নজরদারি করছে নির্বাচন কমিশন। এজন্য ইসিতে নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। আজ সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপিসহ ১৬ দল ভোট বর্জন করেছে। ইতোমধ্যে ভোট ঘিরে রাজনৈতিক বিরোধিতায় অবরোধ, হরতালের কর্মসূচির মধ্যে বেশ কিছু গোলযোগ, সংঘর্ষ ঘটেছে। আবার ভোটারদের কেন্দ্রে টানতে নানা উদ্যোগও রয়েছে এবার। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার ঘিরেও গোলযোগের ঘটনা রয়েছে। ভোটের শেষ মুহূর্তের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, হামলা-সংঘাতের মধ্যে এ নির্বাচনের প্রচার শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হয়। প্রতীক বরাদ্দের পর ১৮ ডিসেম্বর সারা দেশে আনুষ্ঠানিক ভোটের প্রচার শুরু হয়েছিল। বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন প্রার্থীরা। মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল গ্রাম-গঞ্জ-নগর-মহানগর-হাটবাজারের অলিগলি ও রাজপথ। সব প্রস্তুতি শেষে সবাইকে ভোট দিতে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনে অনিয়ম হলে প্রয়োজনে কেন্দ্র বা নির্বাচনি এলাকার ভোট গ্রহণ সামগ্রিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে। গতকাল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির মধ্যে জাতির উদ্দেশে ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি। সন্ধ্যা ৭টায় তাঁর এ ভাষণ রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়।
আগামী পাঁচ বছরের জন্য জাতীয় সংসদের জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের ভোটে এবার রায় দেবেন ২৯৯ আসনে ১১ কোটি ৯৩ লাখের বেশি ভোটার। ভোটের মাঝপথে নওগাঁ-২-এ একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যুতে এ আসনে ভোট পরে হবে। এ আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দুজন প্রার্থী আছেন। নতুন তফসিলে নতুন প্রার্থীও যোগ হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এবার নির্বাচনে ২৯৯ আসনে প্রার্থী রয়েছেন ১ হাজার ৯৬৯ জন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র ৪৩৭ এবং বাকি ১ হাজার ৫৩২ জন হচ্ছেন দল মনোনীত। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৯৭ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রায় ১২ কোটি ভোটারের এ নির্বাচনে নিরাপত্তার চাদরে থাকবে পুরো দেশ। ৪২ হাজারের বেশি কেন্দ্রের ২ লাখ ৬০ হাজার কক্ষে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮ লাখের মতো সদস্য, ৯ লাখের মতো ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, নির্বাহী হাকিম, বিচারিক হাকিমসহ আরও অনেক লোক নির্বাচনি কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, স্থানীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষক রয়েছেন ২৫-৩০ হাজারের মতো। এবারের নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটের আবেদন পড়েছে ১১ হাজার ৮৮২টি।
সরবরাহ করা হচ্ছে ভোটের সরঞ্জাম -বাংলাদেশ প্রতিদিন
একনজরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন : ২৯৯ আসনে ভোটার ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৪ জন। পুরুষ ৬ কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার ১৯৭, নারী ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮৮৯ ও হিজড়া ৮৪৮ জন। মোট ভোট কেন্দ্র ৪২ হাজার ২৪টি। ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৬টি। ২৯৯ আসনে এবার নির্বাচনি লড়াইয়ে রয়েছেন ১ হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৫৩২ জন ২৮ দলের মনোনীত প্রার্থী; বাকি ৪৩৭ জন স্বতন্ত্র।
কোন দলের কত প্রার্থী : ২৮ দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের (নৌকা) ২৬৫, জাতীয় পার্টির (লাঙল) ২৬৪, জাকের পার্টির (গোলাপ ফুল) ২১, তৃণমূল বিএনপির (সোনালি আঁশ) ১৩৫, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (আম) ১২২, বাংলাদেশ কংগ্রেসের (ডাব) ৯৬, জাসদের (মশাল) ৬৬, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (একতারা) ৭৯, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের (ছড়ি) ৬৩, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফের (টেলিভিশন) ৪৫, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএমের (নোঙর) ৫৬, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের (ফুলের মালা) ৩৮, ইসলামী ঐক্যজোটের (মিনার) ৪২, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের (চেয়ার) ৩৯, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের (মোমবাতি) ৩৭, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের (গামছা) ৩০, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির (হাতুড়ি) ২৬, গণফ্রন্টের (মাছ) ২১, জাতীয় পার্টি-জেপির (বাইসাইকেল) ১৩, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির (হাতঘড়ি) ১৬, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (বটগাছ) ১১, বিকল্পধারা বাংলাদেশের (কুলা) ১০, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (কাঁঠাল) ৫, গণতন্ত্রী পার্টির (কবুতর) ১০, গণফোরামের (উদীয়মান সূর্য) ৯, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের (চাকা) ৪, বাংলাদেশ ন্যশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের (কুঁড়েঘর) ৫, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএলের (হাত পাঞ্জা) ৪ ও স্বতন্ত্র ৪৩৭ জন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পাশাপাশি তাদের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপির ছয়জন নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন।
মোটরসাইকেল চলবে না তিন দিন : ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে ভোটের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা নির্বাচনি এলাকায় সভাসমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রা করা যাবে না। শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি বিকাল ৪টা পর্যন্ত সভাসমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রা করা যাবে না। নির্বাচনের আগে ও পরে মিলিয়ে ৭২ ঘণ্টা দেশজুড়ে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে; যা শুক্রবার মধ্যরাতে শুরু হবে। একই সঙ্গে ট্যাক্সিক্যাব, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক চলাচলও বন্ধ থাকবে শনিবার মধ্যরাত থেকে ভোটের দিন রবিবার মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলেছে, শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) মধ্যরাতে শুরু হয়ে ভোটের পরদিন সোমবার (৮ জানুয়ারি) মধ্যরাত পর্যন্ত বাইক চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। তবে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক বা জরুরি কোনো কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল চলতে পারবে। এজন্য রিটার্নিং অফিসারের অনুমোদন নিতে হবে এবং স্টিকার প্রদর্শন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষকদের বহনকারী যানবাহনের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন, ওষুধ, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ও সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন চলাচলে কোনো বাধা নেই। এ ছাড়া বিদেশ থেকে দেশে আসা এবং বিদেশে যাওয়া ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনকে বহনকারী যানবাহন চলাচলে বাধা থাকবে না। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উড়োজাহাজের টিকিট দেখাতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে দূরপাল্লার যাত্রী বহনকারী এবং দূরপাল্লার যাত্রী হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে যাতায়াতের জন্য যে কোনো ধরনের যানবাহন চলাচলেও কোনো বাধা থাকছে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য একটি এবং প্রার্থীর এজেন্টদের জন্য একটি গাড়ি রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষ স্টিকার দেখিয়ে চলাচল করতে পারবে।
স্মার্ট অ্যাপে ভোট পড়ার হারসহ সব তথ্য জানা যাবে। ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি অ্যাপ’-এর হোম পেজে ‘নির্বাচনের তথ্য’ ও ‘নির্বাচনি ফলাফল’ বাটন রয়েছে। এ পেজে আসনগুলোর তথ্য, একনজরে, আইনবিধি, নিবন্ধিত দল ও নোটিস বোর্ড বাটন রয়েছে। আসনগুলোর তথ্যে বিভাগভিত্তিক আসন, সে আসনের প্রার্থী পরিচিতি ও ভোট কেন্দ্রের তথ্য রয়েছে। কেন্দ্রের তথ্য জানার পাশাপাশি একনজরে বাটনে মোট ভোটার, নারী-পুরুষ, দল, প্রার্থী সংখ্যার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অ্যাপের সাহায্যে প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর চলমান ভোটিং কার্যক্রমের তথ্য ও কত ভোট পড়ল তা-ও জানা যাবে অ্যাপে।
পর্যবেক্ষক : দেশি প্রতিষ্ঠানের ২০ হাজার ৭৭৩, বিদেশি পর্যবেক্ষক ১৫৮, বিদেশি সাংবাদিক ৭৬ এবং বিভিন্ন দেশের নির্বাচন কমিশনার ও তাদের প্রতিনিধি ১৮ জন।
ভোটের কর্মীবাহিনী : ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার জেলা এবং ৫৯০ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার উপজেলা পর্যায়ে সার্বিক তত্ত্বাবাধনে দায়িত্ব পালন করবেন। ৪২ হাজার ২৪ জন প্রিসাইডিং অফিসার থাকবেন কেন্দ্রের দায়িত্বে। তাদের অধীনে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং ৫ লাখ ৪২ হাজার ২৫৬ জন পোলিং অফিসার ভোট গ্রহণের মূল কাজটি করবেন।
নিরাপত্তা সদস্য : ভোটের মাঠের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন ভোট কেন্দ্রে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ৩৮ হাজার ১৫০ এবং নৌবাহিনীর প্রায় ২ হাজার ৮০০ জন। প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার পুলিশ; প্রায় ৫ লাখ ১৪ হাজার আনসার ব্যাটালিয়ন। বিজিবি ১ হাজার ১৫১ প্লাটুন (৪৪ হাজার ৯০০ জন প্রায়), ৬০০ টিম র্যাবের, রিজার্ভ ৯৫টিম। কোস্টগার্ড ৭০ প্লাটুন (প্রায় ২ হাজার ৩০০ জন)। ভোট কেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জন নিরাপত্তা সদস্য। সারা দেশে প্রায় ৩ হাজার নির্বাহী হাকিম ও সহস্রাধিক বিচারিক হাকিম।
১০ হাজার ৩০০ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ৪২ হাজারের বেশি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ১০ হাজার ৩০০টিকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা মোট ভোট কেন্দ্রের ২৫ শতাংশ। নির্বাচন কমিশনে এ ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ফল ঘোষণা : কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণনা শেষে প্রিসাইডিং অফিসাররা লিখিত ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। রিটার্নিং অফিসাররা তা ইসিতে পাঠাবেন। ঢাকায় নির্বাচন ভবনের বিশেষ মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করা হবে।