সোমবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

টানা জয়ের ইতিহাস গড়লেন শেখ হাসিনা

রফিকুল ইসলাম রনি

টানা জয়ের ইতিহাস গড়লেন শেখ হাসিনা

টানা জয়ের ইতিহাস গড়লেন বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হাল ধরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে টানা চতুর্থ এবং পঞ্চমবারের মতো দলকে জয়ী করে অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন। ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক সৃষ্টি করলেন শেখ হাসিনা।

এদিকে গতকাল সকালে রাজধানীর ঢাকা সিটি কলেজ কেন্দ্রে নিজের ভোট দিয়ে বুথ থেকে বের হয়ে সেখানে উপস্থিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আশা করি নৌকা মার্কা জয়লাভ করবে। আবারও আমরা জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করব। বাংলাদেশে যে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারব। এ বিশ্বাস আমাদের আছে। আমরা জনগণের সব রকম সহযোগিতা চাই।’

টানা চারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নজির বিশ্বে খুব বেশি নেই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবেও তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বিদেশের মাটিতে রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় নিয়ে থাকতে হয়েছে শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানাকে। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে ১৯৮১ সালে দলের কাউন্সিলে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। তৎকালীন শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। হাল ধরেন উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের। সে সময় থেকে তিনি পায়ে হেঁটে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন। বিরোধী পক্ষ ও দলের ভিতরে নানামুখী ষড়যন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে সংগঠনকে শক্তিশালী করেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেতাই থেকে যেতে হয় তাকে। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসতে দেওয়া হয়নি। আবারও হন বিরোধীদলীয় নেতা। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভূমিধস জয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর টানা তিন মেয়াদ শেষ করে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন তিনি।

দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বগুণে শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে দেশের গন্ডি পেরিয়ে স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বনেতৃত্বের কাতারে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ১৫ বছর শেখ হাসিনার অনবদ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন তিনি। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে খুলেছে অনেক সম্ভাবনার দুয়ার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মেট্রোরেলে গতিময় পথ হয়েছে ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রামে নদীর তলদেশে দুই পাড়ের মানুষকে করেছে এক। ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হাতছানি সেখানে। এসবের মধ্যে ছিল মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ‘শেখ হাসিনা সরণি’, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর চ্যানেল, পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে রেল এবং সারা দেশে বহু মডেল মসজিদ নির্মাণসহ বেশকিছু প্রকল্প। বিনামূল্যে গৃহহীনদের ভূমিসহ ঘর প্রদান। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেটের কলেবর বেড়েছে ৮ গুণ। দেশের জনগণের বিশ্বাস, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে। গত ২৭ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ শিরোনামে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তাঁর ঘোষিত ‘ভিশন-২০২১’ অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ আর ২০৪১ সালে হবে উন্নত দেশ। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ১৯৯৬ সালে। ওই বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নেন। ২০০১ সালে মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তখন একটি নির্বাচিত সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারার রেকর্ডও অর্জিত হয় শেখ হাসিনার হাত ধরেই। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন তিনি। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ওই বছরের ১২ জানুয়ারি টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয় এবং মোট চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিবের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শেখ হাসিনা। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। এই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতিও ছিলেন। দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে শক্তহাতে হাল ধরেন দলের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সহস্র বাধা অতিক্রম করে জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে দেশে ফেরার ২১ বছরের মাথায় আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি। হত্যা করতে তার ওপর কমপক্ষে ১৯ বার হামলা করা হয়। এরশাদ শাসনামলে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন নিহত হন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাঁকেসহ তাঁর গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও আওয়ামী লীগের ৩০ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন চলাকালে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে তাঁর কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়। বিএনপি সরকারের সময় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ওইদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা করা হয়। ইতিহাসের ভয়ংকর ও রোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ তাঁর দলের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হন এবং ৫০০-এর বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান। শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ভাত-ভোট এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। সামাজিক কর্মকান্ড, শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য শেখ হাসিনাকে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা বহুবার পুরস্কৃত করেছে।

জনগণের সবরকম সহযোগিতা চাই : ঢাকা সিটি কলেজ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আশা করি নৌকা মার্কা জয়লাভ করবে। আবারও আমরা জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করব। আমরা জনগণের সবরকম সহযোগিতা চাই। সকাল ৭টা ৫৫ মিনিটে ছোট বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ ও শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিককে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। ঢাকা-১০ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্রে স্বাগত জানান। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের কাছে নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি না, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলে নির্বাচন নিয়ে আর কে কী বলল তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। জনগণ যাকে খুশি ভোট দিক। কিন্তু নির্বাচনটা যেন সুষ্ঠুভাবে হয় সেটাই আমরা চাই। বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন নিয়ে কে কী বলছে তা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামান না। আমাদের দেশ একটি সার্বভৌম এবং স্বাধীন দেশ। এটি ছোট দেশ হতে পারে, কিন্তু এর জনসংখ্যা অনেক বেশি। জনগণই আমাদের প্রধান শক্তি, কাজেই কে কী বলে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমরা সব বাধা মোকাবিলা করে একটি অনুকূল নির্বাচনি পরিবেশ নিশ্চিত করেছি।

তিনি বলেন, জনগণের কাছে আমার জবাবদিহিতা আছে। জনগণের কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি না সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শুক্রবার রাতে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত চক্র নির্বাচন অনুষ্ঠানকে বাধাগ্রস্ত করতে ট্রেনে, বাসে আগুন লাগিয়ে এবং মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে নাশকতামূলক কর্মকান্ড করছে। আসলে বিএনপি-জামায়াত চক্র গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা চায় না। তারা জনগণের কল্যাণে কাজ করে না। নির্বাচনে জয়লাভের বিষয়ে আস্থা ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘আমি আশা করি যে নৌকা মার্কা জয়লাভ করবে এবং আবার আমরা জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের যে মর্যাদা পেয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারব। এ বিশ্বাস আমার আছে, জনগণের ওপর আমার বিশ্বাস আছে।’

 

সর্বশেষ খবর