শিরোনাম
বুধবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
গণভবনে প্রধানমন্ত্রী

মুরুব্বিদের অসৎ পরামর্শ দেশে চলবে না

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দু-চারটি দল নির্বাচনে না এলে কিছু হয় না। সবাইকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে হবে সংঘাত চাই না

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুরুব্বিদের অসৎ পরামর্শ দেশে চলবে না

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি ও তাদের মুরুব্বিরা নির্বাচন চায়নি। এসব মুরুব্বির অসৎ পরামর্শের রাজনীতি বাংলাদেশে চলবে না।

গতকাল দুপুরে গণভবনে ৭ জানুয়ারির ভোটের পর সর্বসাধারণের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫-এর পর বাংলাদেশে যত নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে এ নির্বাচন সবচেয়ে সুশৃঙ্খল, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ নির্বাচন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মঞ্চে শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় মঞ্চের দুই পাশে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন যাতে না হয় তার জন্য বিএনপি নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করেছিল। মুরুব্বিদের কথা শুনলে বাংলাদেশ আর চলা লাগবে না। এটাই হলো বাস্তবতা। যদি সৎ পরামর্শ হয়, সেটা ভালো কথা। নির্বাচন হতে দেবে না, এসব হুমকি-ধমকি গেল কোথায়। মুরুব্বিদের অসৎ পরামর্শের রাজনীতি বাংলাদেশে চলবে না। তিনি বলেন, যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি তাদের নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর দেশে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে এনেছে আওয়ামী লীগ। ভোট বর্জনকারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হতাশার কিছু নেই, আপনারা তো এ দেশেরই জনগণ। হয়তো আপনাদের ওপর ওহি নাজিল হয়েছে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি, ডিজিটালের সুবাদেই ওহি নাজিল হয়। নিজেরা লন্ডনে বসে আয়েশ করে পায়েস খায়, আর এখানে কর্মীদের মাঠে নামায়। মাঠে নামায় আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াতে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫-এর পর নির্বাচন মানে কী আমি দেখেছি, নির্বাচন মানে ছিল নামেই নির্বাচন। ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি, ভোটার লিস্টের মিথ্যা নাম দেওয়া। আর সংবিধান লঙ্ঘন করে, সেনা আইন লঙ্ঘন করে যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের পকেট থেকে রাজনৈতিক দল বের হতো। ওই দল মাটি মানুষের কথা বলে গঠিত না। ক্ষমতার উচ্চ আসনে বসে গঠিত রাজনৈতিক দল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই দল না। আওয়ামী লীগ হচ্ছে মানুষের অধিকারের কথা বলার জন্য। যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছিল না, তখনই আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। জনগণের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে, জনগণের অধিকার রক্ষায় আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, সৃষ্টির লগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ জনগণের স্বার্থে কাজ করে গেছে। আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য বারবার অনেকেই এসেছে, আইয়ুব খানও চেষ্টা করেছে, ইয়াহিয়া খানও চেষ্টা করেছে, জিয়াউর রহমান চেষ্টা করেছে, এরশাদ চেষ্টা করেছে। জিয়াউর রহমান যেমন হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, সেভাবে খালেদা জিয়াও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আমাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী না, এদেশের প্রতিটি শ্রেণির মানুষ আজকে তাদের (বিএনপি) দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। একটা মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকলে কোনোদিন এভাবে পুড়িয়ে মারতে পারে না।

বিএনপির ভোট বর্জনের প্রসঙ্গ ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ভেবেছিল একেবারে ক্ষমতায় চলে যাবে। মাত্র ৩০টা সিট পেয়েছিল। এরপর থেকে তারা জানে, বাংলাদেশের মানুষ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, মানুষ হত্যা এগুলো পছন্দ করে না। তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। যে কারণে তারা কোনো নির্বাচনে আসতে চায়নি। বাংলাদেশের মানুষ কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯৬ সালে খালেদা জিয়া ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিল, শত চেষ্টা করেও ভোটার আনতে পারে নাই। তারপর সিল মেরে, বাক্স ভরে সবকিছু করেছিল, সারা জায়গায় আর্মি নামিয়েছিল, পুলিশ নামিয়েছিল, সব নামিয়েছিল। তারপরও সে নির্বাচন হয়নি এবং জনগণ মেনে নেয়নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয়েছিল, ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া ভোটচুরির অপরাধ নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। সে কথা জনগণ ভুলে যায়নি মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৬ সালের নির্বাচনেও ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে এ নির্বাচন করতে চেয়েছিল। সেই নির্বাচনও টিকাতে পারে নাই। ইমারজেন্সি ডিক্লেয়ার হয়, খালেদা জিয়াও যায়, তার নির্বাচনও যায়। এদের তাও শিক্ষা হয় না, লজ্জা হয় না। তিনি বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছে। দুই চারটি দল নির্বাচনে না এলে কিছু হয় না। যারা নির্বাচন নিয়ে খেলতে চেয়েছিল তারা ব্যর্থ হয়েছে। সুশৃঙ্খল নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন যে হতে পারে এবার তা প্রমাণ হয়েছে।

নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ করে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ নির্বাচন নিয়ে তারা বড় খেলা খেলতে চেয়েছিল। তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর ব্যর্থ যারা হয় তাদের মধ্যে একটা প্রতিহিংসা জাগ্রত হয়। আপনারা কোথাও যদি এতটুকু গোলমাল করেন তাহলে ওই সুযোগটা চক্রান্তকারীরা নিতে চেষ্টা করবে। কোনো প্রকার দ্বন্দ্বে না জড়ানোর আহ্বান নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, এরপর যেন কোথাও কোনো রকম, কারও সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব, কোনো কিছু না হয়। যারা জয়ী হয়েছে সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন, সেটা অন্য দল বা স্বতন্ত্র সবাই মিলে এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে পেছনে কিন্তু শত্রু লেগে আছে। এরা মানুষ পোড়ানো থেকে শুরু করে এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই তারা করে না। কাজেই শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের মানুষ সাধারণ মানুষ যে ম্যান্ডেট দিয়েছে, সেই ম্যান্ডেট মেনে নিয়ে সবাইকে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, অনেককে নমিনেশন দিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম তারা জয়ী হবে। কিন্তু জয়ী হতে পারেননি। জনগণ ভোট দিয়েছে সেখানে করার কিছু নেই। জনগণ যেহেতু ভোট দিয়েছে সেহেতু কোনো ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ যেন না থাকে। সবাই শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থাটা ধরে রাখতে হবে। এখানে কোনো প্রকার সংঘাত আমরা দেখতে চাই না। যা কিছু হয়েছে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত। যেহেতু জনগণ ভোট দিয়েছে, সুতরাং এখানে কারও কোনো অভিযোগ-অনুযোগ থাকার কথা থাকে না। জনগণের ওপর আস্থা বিশ্বাস রাখতে হবে। ভোট না দিলেও তার কাছে যেতে হবে, বলতে হবে এবং তাদের জন্যই আমাদের কাজ করতে হবে; এই কথাটি মনে রাখতে হবে। এ সময় সংসদে থাকা এবং সংসদের বাইরে থাকা সব নেতাকে নিজের সামর্থ্যে সবটুকু ঢেলে দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করার, তাদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশও দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণেই শেষ কথা মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওদের (বিএনপি-জামায়াত) হাত থেকে কিন্তু কেউ রেহাই পায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতিদের কোয়ার্টার আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তো সবসময় তাদের শিকার। তাদের ভয়াল চেহারা যখন মানুষ দেখেছে, তখন বিএনপিকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই তারা নির্বাচনে আসে নাই বলে কিছুই যায় আসে নাই। ওরা চক্রান্ত করছিল এই নির্বাচন কিছুতেই হতে দেবে না। আমরা কিন্তু বিকল্প পথ নিয়েছিলাম। আমরা নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম। স্বতন্ত্র কেউ নির্বাচন করতে চাইলে বা অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। আর বলতে পারবে না যে রাতে সিল মেরেছে। কারণ ব্যালট পেপার রাতে যায়নি। কেন্দ্রে গেছে সকালে। যে কথাটা তারা সারা দিন বলে বেড়াতো সেই কথাটা বলার আর সুযোগ নেই। অনেক ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আগে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর ন্যস্ত ছিল। আমরা কিন্তু সেটাও সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিছি। এখন আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হয়। বাজেটে আলাদা অর্থ কমিশনকে দেওয়া হয়, যাতে খরচ করতে পারে। নির্বাচন চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসন, এমনকি একটা বদলিও সরকারের করার কোনো সুযোগ থাকে না। এটা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এটা করতে পেরেছি। নির্বাচনে নিজের দলের প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কেউ এভাবে ইলেকশন উন্মুক্ত করে দেয় না। আতঙ্কিত থাকতে পারে, যদি সিট কম পায় বা সরকার গঠন করতে না পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের সেই ভয় ছিল না। কারণ জনগণ যা চাইবে তাই হবে। জনগণ যদি আমাদের ভোট না দেয়, আমরা যদি ক্ষমতায় যেতে না পারি, কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে তুলে দিতে পেরেছি সেটাই আমাদের সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। আগে ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ছিল না বন্দি ছিল ক্যান্টনমেন্টে। সেটা আমরা এনে দিয়েছি জনগণের হাতে। জনগণ আজ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। শীতের সকাল উপেক্ষা করে ভোট কেন্দ্রগুলোতে বিপুল সংখ্যক ভোটের উপস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশেষ করে নারী যারা তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই যে, এবারে নির্বাচনে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। আমরা যে নারীর ক্ষমতায়নে অনেক কিছু করেছি এটাই তার প্রমাণ। পত্রিকায় দেখলাম আমার নির্বাচনি এলাকার ১২০ বছর বয়সী নারী ভোট দিতে কেন্দ্রে গেছেন। তিনি ( ওই নারী) বলেছেন, ‘আর কয় বছর বেঁচে থাকি ঠিক নেই, হাসিনাকে ভোটটা দিয়ে যেতে চাই’। দেশজ উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। নিজেদের পায়ে নিজেদের দাঁড়াতে হবে। নিজেদের উৎপাদন নিজেরা করতে হবে। অনেকেরই চক্রান্ত ষড়যন্ত্র আছে যে, দুর্ভিক্ষ ঘটাবে, অমুক করবে, তমুক করবে। সেটা যাতে কোনোভাবে করতে না পারে, সেজন্য আমাদের এখন থেকেই সচেতন থাকতে হবে। আমাদের উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো মাস্টার নেই। বাংলাদেশের জনগণই আমাদের মাস্টার। বাংলাদেশের জনগণই আমাদের শক্তি। আর বাংলাদেশের জনগণ আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস। এই বিশ্বাস নিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

 

সর্বশেষ খবর