রবিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বস্তিতে আগুনে গেল দুই প্রাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বস্তিতে আগুনে গেল দুই প্রাণ

গতকাল অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বিএফডিসি গেট সংলগ্ন মোল্লাবাড়ী বস্তি -জয়ীতা রায়

হাড়কাঁপানো শীতে খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এফডিসি-সংলগ্ন মোল্লাবাড়ী বস্তির হতভাগা বাসিন্দারা। শুক্রবার দিবাগত রাতে ভয়াবহ আগুনে এরই মধ্যে দুজনের করুণ মৃত্যু হয়েছে। এ আগুনে প্রায় ৩০০টির মতো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় আগুনে পোড়া দুই লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। রাত আড়াইটার আগুনে পুড়ে যাওয়া বস্তি পরিদর্শন করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান, ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা। মোল্লাবাড়ি বস্তির অগ্নিকাণ্ডে ঘটনা তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল সকাল ১১টার দিকে সরেজমিনে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় হাজারখানেক মানুষ এক কাপড়ে খোলা আকাশের নিচে। তীব্র শীতে কী করবেন সে বিষয়ে কিছু জানা নেই তাদের। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, সকাল থেকে তারা কিছু খেতে পারেননি। সহায়তার জন্যও কেউ আসেনি। পুলিশ বলছে, আগুন লাগার পরে ওই বস্তি থেকে মা শারমিন আক্তার ও তার ছয় বছরের ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে নাজমা বেগম (২৫) ও তার শিশু সন্তান নজরুল ইসলাম (৪) অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম মশিউর রহমান জানিয়েছেন, মোল্লাবাড়ি বস্তিতে আগুনের ঘটনার পর মা-ছেলে নিখোঁজ আছে। তবে যে লাশ দুটি উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা, সেগুলো একেবারে পুড়ে গেছে। লাশ দুটি শনাক্ত করা যাচ্ছে না। হতে পারে লাশ দুটি মা-ছেলের, তবে নিশ্চিত নয়।

প্রলয়ঙ্করী আগুনে সব হারিয়ে নিঃস্ব স্বপ্না বেগম। কাওরানবাজার মাছ কাটেন। স্বামী নেই। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একাই ওই বস্তির একটি ঘরে থাকতেন। এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি বলছিলেন, মানুষের চিৎকার শুনে তিনি দেখেন তার ঘরের কাছেই আগুন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রাণে বাঁচতে চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু এত মানুষের মাঝে বের হতে গিয়ে কয়েকবার পড়ে যান। তার পরও কোনো রকমে বের হয়ে আসেন। কিছু নিয়ে বের হতে পারেননি।

এফডিসি-ঘেঁষা মোল্লাবাড়ি বস্তিতে কাঠ, বাঁশ আর টিনের তৈরি একতলা- দোতলা আনুমানিক ৩০০ ঘরবাড়িতে বসবাস করতেন নিম্নআয়ের মানুষ। এই বস্তির বয়স ২৫/৩০ বছর। বস্তিতে অন্তত সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০-এর মতো ঘর ছিল। প্রতিটি ঘর ৮ ফিট বাই ১০ ফিটের মতো। প্রতিটি ঘরের ভাড়া ছিল সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা।

রাজধানীর বস্তিতে পুড়ে ছাই ঘরে শেষ সম্বল পাওয়ার চেষ্টা -জয়ীতা রায়

বস্তির বাসিন্দারা বলছিলেন, শুক্রবার রাতের আগুনে পুড়ে গেছে কমপক্ষে ৩০০ ঘর। ভয়াবহ এই আগুন থেকে বেশির ভাগ বস্তিবাসীই পরনের কাপড় ছাড়া জিনিসপত্র কিছুই রক্ষা করতে পারেননি।

মাছের আড়তে কাজ করা মোহাম্মদ মুছা তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তার শেষ সম্বল কিছু পাওয়া যায় কি না সেটা দেখছিলেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রাতে তার দুই ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। এর মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কাজ করা লোকজন ইটপাটকেল ছুড়ে মারে টিনের চালে ও চিৎকার করতে থাকে আগুন আগুন বলে। দ্রুত তিনি ও তার পরিবার নিয়ে বের হয়ে আসেন। সঙ্গে কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি। এখন এক কাপড়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হয়েছে তাদের।

তিনি বলেন, সংসারে সব কিছু ছিল তার। খাট, ওয়্যারড্রব, ফ্রিজ সব পুড়ে শেষ। ব্যবসার জন্য ধারদেনা করে ও জমিয়ে রাখা প্রায় দেড় লাখ টাকা ছিল তার। সেগুলো সব শেষ।

কাঁচামালের ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, তারা সাধারণত মালামাল কেনার জন্য রাতে বের হন। ঘটনার সময় তারা ঘুমিয়ে ছিলেন। শব্দ শুনে বের হয়ে দেখেন আগুন ধেয়ে আসছে। কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালান তারা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বস্তিতে সাধারণত গ্যাস লিকেজ কিংবা শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকে। এ বস্তিতেও একই কারণে আগুন লেগেছে বলে আমাদের প্রাথমিক ধারণা। তবে আমরা তদন্তের মাধ্যমে জানতে পারব, আসলেই কী কারণে আগুন লেগেছে। এ ঘটনায় দুজন মারা গিয়েছেন এবং ৩০০টির মতো ঘর পুড়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে নিহতদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে নিহতদের মধ্যে একজন নারী ও অন্যজন শিশু। লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগুনের খবর পাওয়ার পরপরই ঘটনাস্থলে আসেন এবং ১৩টি ইউনিটের প্রায় দেড় ঘণ্টার প্রচেষ্টায় রাত ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

যা বললেন ডিএমপি কমিশনার : ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় মোল্লা বস্তির আগুনের কারণ এখানো জানা যায়নি। অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা না নাশকতা তা তদন্তের পর জানা যাবে। বস্তি থেকে বের হওয়ার রাস্তা সংকীর্ণ থাকায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া দুজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এই দুজনই যে নিখোঁজ হওয়া দুজন হতে পারেন, তা ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে জানা যাবে। কমিশনার বলেন, বস্তিটি একজনের মালিকানাধীন। তিনিই ঘর করে এখানে ভাড়া দিতেন। মালিক এবং বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আগুনের ঘটনা নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি : মোল্লাবাড়ি বস্তির অগ্নিকাণ্ড তদন্তের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন, সহকারী পরিচালক (ঢাকা) মো. আনোয়ারুল হক, উপসহকারী পরিচালক (জোন-১৪) মো. তানহারুল ইসলাম এবং সিনিয়র স্টেশন অফিসার (তেজগাঁও) মো. নাজিম উদ্দিন।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাত আড়াইটার দিকে মোল্লা বস্তিতে আগুন লাগে। খবর শুনে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ছাড়া গত রাতে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ২২ নম্বর বাসায় পৌনে ৭টার দিকে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ৭টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

 

সর্বশেষ খবর