মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মাদকের ভয়ংকর নেটওয়ার্ক

ধরাছোঁয়ার বাইরে গডফাদাররা, কক্সবাজার থেকে ঢাকা ব্যবহার হয় সড়ক নৌ রেল ও সমুদ্রপথ উৎকণ্ঠা রূপগঞ্জ চনপাড়া বস্তি, নতুন নতুন মাদকের সমাহার সারা দেশের গ্রামেগঞ্জে

মাহবুব মমতাজী, ঢাকা ও মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

মাদকের ভয়ংকর নেটওয়ার্ক

সারা দেশে মাদকের ভয়াবহ জাল বিস্তৃত হয়েছে। এর মাধ্যমে নানা পদ্ধতিতে মাদক ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। এর সঙ্গে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ইয়াবার থাবা। সঙ্গে আইস, টাপেনটাডলের মতো অপ্রচলিত মাদক ছড়িয়ে পড়ছে যত্রতত্র। জানা গেছে, মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশারীরা। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে মাদকের গডফাদাররা। গত এক বছরে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে অন্তত হাজার কোটি টাকার প্রাণঘাতী মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস দেশে ঢুকেছে। এ সময় ধরা পড়েছে অর্ধশত আইসের ছোট-বড় চালান। একই দেশ থেকে ইয়াবারও ছোট-বড় অনেক চালান ঢুকেছে। এদিকে আকাশপথেও কোকেন, ইয়াবা ও আইসের চালান আসছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু চালান জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। আর রাজশাহী, সিলেট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় ঢুকছে ইয়াবা, গাঁজা ও হেরোইনের চালান। ঢাকার পাশে সবচেয়ে বড় বস্তি রূপগঞ্জের চনপাড়া মাদক কেনাবেচার অন্যতম বড়  কেন্দ্র। এখানে ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইস ও টাপেনটাডল খুব সহজেই পাওয়া যায়। এ কারণে এ এলাকায় সার্বক্ষণিক বহিরাগতদের আনাগোনা থাকে এবং এ এলাকা হয়ে সারা দেশে মাদক ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা গেছে। আর ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরেও সরবরাহ হচ্ছে ইয়াবা, আইস ও ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, উত্তরের তিন জেলা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও দিনাজপুরের সীমান্ত দিয়েও আসছে মাদক। গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা সীমান্তবর্তী এসব জেলা থেকে সারা দেশে সরবরাহ করছে চোরাকারবারিরা। প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ও কৌশলে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া তিস্তার চর যেন মাদকের নিরাপদ হাটে পরিণত হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার সীমান্ত পথে গড়ে উঠেছে মাদক চোরাচালানের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর মধ্যে লালমনিরহাট সদর ছাড়া আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতিবান্ধা ও পাটগ্রাম সীমান্ত পথে আসা মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে তিস্তার চর পেরিয়ে। কোনো কোনো সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বিমানবন্দর থানা পুলিশ জহিরুল ইসলাম ও আবদুল বারী নামে দুই মাদক বহনকারীকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে কোটি টাকা মূল্যের ৮৯০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। দুই মাদক কারবারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বনলতা আন্তনগর এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে হেরোইন হাতবদলের অপেক্ষায় একটি হোটেলের সামনে অবস্থান করছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈর ও নওগাঁয় অভিযান চালিয়ে ৫ কেজি ৪০০ গ্রাম হেরোইন জব্দের ঘটনায় শাকিবুর, তার স্ত্রী সেলিনা খাতুন ওরফে শিরিনাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১২ এর একটি দল। শাকিবুর ও শিরিনার নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি মাদক বহনকারী দল কাজ করছিল সহযোগী হিসেবে। তারা র‌্যাবকে জানায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ি এলাকার মাদক সম্রাট শহিদুল ইসলাম ভোদল ও মোহন সীমান্ত পথে হেরোইনের বড় বড় চালান এনে বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকায় আনছিলেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদকের কারণে খুনোখুনিসহ সব ধরনের অপরাধ বাড়ছে। অনেক পরিবার ভেঙে পড়ছে। মাদকাসক্তের ৮০ শতাংশই তরুণ-তরুণী; ৮৫ শতাংশ মাদকাসক্ত ইয়াবা গ্রহণ করেন। গত পাঁচ বছরে মাদকাসক্ত বেড়েছে তিন গুণ। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, মাদক এখন সমাজে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণগুলো হলো- মাদকের অনেক প্রকরণ রয়েছে, যেগুলো (ইয়াবা ও ফেনসিডিল) সহজে তৃণমূল মানুষ, বস্তিবাসী ও অভিজাত এলাকার মানুষের হাতের নাগালে পায়। এর জন্য ছোট-বড় থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষেরা এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে সঙ্গদোষ অর্থাৎ একজন খেলে পাশে থাকা বন্ধুও আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া এক্সপেন্সিভ মাদকগুলো অভিজাত এলাকার মানুষেরা বিভিন্ন ক্লাবে চর্চা করে থাকে। যে কারণে সবার কাছে সহজে মাদক পৌঁছে যায়। মাদক বিস্তারে নৈপথ্যে একটা সিন্ডিকেট চক্র রয়েছে। এটার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের রথী-মহারথী এমনকি অনেক রাজনীতিক নেতাও এর সঙ্গে জড়িত। কেউ অর্থ দিয়ে, আবার কেউ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এখানে মদদ জোগাচ্ছে। শুধু মাদক বিস্তার নয়, এর সঙ্গে ব্যবসা ও বাণিজ্য রয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রথমে উৎস বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কেও কঠিন ভূমিকা রাখতে হবে। এগুলো ছাড়াও সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বইপুস্তকের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো এবং পরিবারের গঠনমূলক ভূমিকাও প্রয়োজন মাদক নিয়ন্ত্রণে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে ৩৬ কেজি আইস জব্দ করা হয়। ২০২২ সালে জব্দ হয়েছে ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম। গত বছরের এপ্রিলে ১২ দিনে জব্দ করা হয় ৪৪ কেজি আইস। যার বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল থেকে ২৪ কেজি আইস জব্দ করে র‌্যাব, যা দেশে এখন পর্যন্ত জব্দ করা আইসের সবচেয়ে বড় চালান। যার বাজারমূল্য ১২০ কোটি টাকা। এর আগে সীমান্তের রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে দেশে আনার সময় ২১ কেজি ৯০ গ্রাম আইসসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে ২ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার ৬১২ পিস ইয়াবা, কোকেন জব্দ হয়েছে ৯ দশমিক ৬৮৪ কেজি এবং ফেনসিডিল জব্দ হয়েছে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ২৪০ বোতল। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন মাদক জব্দের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০ লাখ ২৮ হাজার ৬৫২টি। আসামি করা হয়েছে ১৩ লাখ ৯ হাজার ৪৭৯ জনকে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে নারায়ণগঞ্জ বন্দরসহ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করা ছোট ছোট লাইটার জাহাজ, বাল্কহেডে করে আসছে ক্রেজি ড্রাগস ‘ইয়াবা’। তবে বাদ থাকছে না স্থলপথও। বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক এবং লরি কন্ট্রাক্ট করে আনা হচ্ছে ফেনসিডিল এবং ইয়াবা। কাঁচপুর, ডেমরায় থাকা নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা এসব মাদকের চালান বিশেষ প্রটেকশন দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন রূপগঞ্জের চনপাড়ায়। ঢাকার পাশের সবচেয়ে বড় এই বস্তিতে প্রায় ২৫ হাজার ঘর রয়েছে। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, মাদক বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা। এর পেছনে দায়ী সামাজিক অবক্ষয়, আইনশৃঙ্খলাজনিত কারণ, আইনের প্রয়োগ, মাদক নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টরা সব সময় কার্যকর ভূমিকা পালন না করার কারণে বিস্তার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে আসা মাদকগুলোর রুট বন্ধ করা খুব কঠিন। সেই সুযোগ নিয়ে অনেকে মাদককারবারি করে। আবার এর মধ্যে যারা দায়িত্ব পালন করে তারা যথাযথ করছে না। অনেকে অসাধু তৎপরতায় জড়িত।

তিনি বলেন, কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিস্তার রোধ করার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন থাকবে তেমনি জনগণ থাকবে। আবার সুশীল সমাজ, অভিভাবক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থাকবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও থাকতে হবে।

কুরিয়ার সার্ভিসে মাদক : কুড়িগ্রামে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পরিবহনের চেষ্টাকালে ১২৫ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করেছে পুলিশ। কুড়িগ্রাম সদরের একটি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পরিবহনের সংবাদ পেয়ে গত ১২ জানুয়ারি রাতে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি টিম অভিযান চালিয়ে বিশেষ কায়দায় কার্টনে রাখা ১২৫ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করে।

এর আগে গত বছরের ৬ মে রাজধানীর মতিঝিলের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় একটি কুরিয়ার থেকে ৫০ হাজার ইয়াবা জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। এ ঘটনায় সাইফুল ইসলাম (৩৯) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। ডিএনসির কর্মকর্তারা সে সময় জানান, ডিএনসি ফরিদপুর জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা কিছুদিন ধরে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তির গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলেন। এরই মধ্যে কর্মকর্তারা তথ্য পান, কক্সবাজার থেকে ইয়াবার একটি চালান কুরিয়ারে করে ঢাকা হয়ে মাদারীপুর যাবে। এ তথ্যের ভিত্তিতে সাইফুল ইসলামকে দিলকুশা থেকে আটক করে ওই কার্যালয়ে তল্লাশি চালানো হয়।

মাদক পাচারের নতুন রুট কক্সবাজার-ঢাকা রেলপথ : মাদক পাচারের নতুন রুটে পরিণত হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চালু হওয়া রেলপথ। কক্সবাজার স্টেশন ও ট্রেনের দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যাপকহারে পাচার করছে ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ও আইস। কক্সবাজার থেকে চালু হওয়া ট্রেনে করে মাদক পাচারের তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর নড়চড়ে বসেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক জাফর উল্লাহ কাজল বলেন, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চালু হওয়া ট্রেনে মাদক পাচারের তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। তাই স্টেশন এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি সোর্স নিয়োগ করা হয়েছে। রেলওয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার হাছান চৌধুরী বলেন, রেলযোগে কক্সবাজার থেকে মাদক পাচার ঠেকাতে রেলওয়ে পুলিশ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। পুলিশ সদস্যরা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশির পাশাপাশি গোয়েন্দা সদস্যরা কক্সবাজার থেকে রেল ছাড়ার আগে কঠোরভাবে নজরদারি করছে।

মাদকে বাড়ছে খুনোখুনি : ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরে মাদক সেবনের প্রতিবাদ করায় শ্বাসরোধ করে লাকী খাতুন নামে এক তরুণীকে হত্যা করে তার প্রেমিক রিপন হোসেন (২৮)। গত বছরের ২ জুন সকালে সাভারের হেমায়েতপুরের জয়নাবাড়ি এলাকার একটি বহুতল ভবনের পাশে কলাগাছের সঙ্গে লাকীর হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার ১৪ দিন পরে খুনিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর টাঙ্গাইল পৌর শহরের এনায়েতপুর এলাকায় সালমা বেগমকে (৫০) কুপিয়ে হত্যা করে মাদকাসক্ত সন্তান আবুল কালাম (৩০)। মাদকের টাকা না দেওয়ায় মাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

পাকস্থলী ও চুলের খোঁপায় ইয়াবা

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর