মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় শেখ হাসিনা

দেশ এগিয়ে নিতে ক্ষমতায় আসা খুব জরুরি ছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন যেন না হয় সেজন্য অনেক চক্রান্ত ছিল, কিন্তু তারা (চক্রান্তকারীরা) ব্যর্থ হয়েছে। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা খুব জরুরি ছিল। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের দল। আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী সংগঠন আমার পাশে আছে বলেই এত কিছু করা সম্ভব হচ্ছে। কারণ মানুষ কতটা সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগকে, তা বোঝা গেছে এবারের নির্বাচনে। তিনি আরও বলেন, ইশতেহার দিয়ে ওয়াদা পূরণ করবে আওয়ামী লীগ, আর দেশের উন্নয়নও আওয়ামী লীগের হাতে।

গতকাল বিকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের যৌথসভায় তিনি এসব কথা বলেন। এ যৌথসভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ, ঢাকা মহানগরী উত্তর-দক্ষিণ এবং সব সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা অংশ নেন। নির্বাচনের পর প্রথম দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কার্যালয়ে পৌঁছালে দলের সাধারণ    সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফুল দিয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানান। সূচনা বক্তব্য দেন ওবায়দুল কাদের। দীর্ঘ ৪০ মিনিট বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী। বক্তৃতা শেষে মহানগরী আওয়ামী লীগ, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারা দলীয় সভানেত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। বক্তব্যে আন্তর্জাতিক জরিপেও আওয়ামী লীগ অনেক এগিয়ে ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেসব জরিপ আন্তর্জাতিকভাবে হয়েছিল তাতে স্পষ্ট ছিল বিএনপি তাদের জন্য নির্বাচন করলে কখনো সরকার গঠন করার মতো সাফল্য অর্জন করবে না। সে রকম সিটও তারা পাবে না। এটা জেনেই তারা নির্বাচনে না এসে সহিংসতার পথ বেছে নেয়। তিনি বলেন, এখন আমরা সরকার গঠন করেছি। জনগণের আস্থা-বিশ্বাস আমরা পেয়েছি। এ বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যে উন্নয়নের কাজগুলো আমরা করছি, সেগুলো সম্পন্ন করতে হবে। দেশের উন্নয়নের ধারা আরও গতিশীল করতে হবে। আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

নির্বাচন ঘিরে দেশের নানা স্থানে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সৃষ্ট সংঘর্ষের ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী জড়িতদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, নির্বাচনে জয়পরাজয় মেনে নিয়ে সবাইকে উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। এবারের উন্মুক্ত নির্বাচনে অনেক দলীয় প্রার্থীই হেরেছেন, কেউ কেউ জিতেছেন। হারজিত যা-ই হোক সেটা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। নিজেরা নিজেদের দোষ ধরতে ব্যস্ত হলে বিরোধীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। এসব মেনে নেওয়া হবে না বলেও সতর্ক করে দেন তিনি।

এ সময় দলের নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যারা নির্বাচন করেছে, কেউ জয়ী হয়েছে, কেউ জয়ী হতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করা বা কার কী অপরাধ, এগুলো খুঁজে বের করা, এসব বন্ধ করতে হবে। আমাদের দল ছাড়া কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, আমরা জনগণের যে সমর্থন পেয়েছি সেটা কিন্তু কাজের স্বীকৃতি। দেশে মানুষের জন্য আমরা কাজ করেছি, দেশের মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে, আমাদের জয়ী করেছে। সেখানে হয়তো কেউ জিততে পেরেছে, কেউ জিততে পারেনি। হারজিত যা-ই হোক সেটা সবাইকে মেনে নিয়ে অন্তত নিজের দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। আমরা যদি একে অন্যের দোষ ধরতে ব্যস্ত থাকি, এটা আমাদের বিরোধী দলকে আরও উৎফুল্ল করবে, তাদের কিছু সুযোগ দেওয়া হবে।

নির্বাচন ঘিরে বিএনপি অনেক চক্রান্ত করেছে অভিযোগ করে শেখ হাসিনা বলেন, সহিংসতার জন্য বিএনপিকে কোনো দলীয় উসকানি দেয়নি আওয়ামী লীগ, পুলিশও অনেক সহনশীল ও সংযত ছিল। তবু বিএনপি দেশের মধ্যে সহিংসতা করেছে। এখন তারা বিদেশি মুরুব্বিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে তারা এমন কর্মকাণ্ড আরও করতেই থাকবে। এ সময় দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাজারে পণ্য থাকার পরও অনেকে কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে। এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। রমজানে মানুষ যেন কষ্ট না পায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। খাদ্যের যেন দাম মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে, সে ব্যবস্থা নেব। মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে বলে কৃষিশ্রমিক পাওয়া যায় না উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কর্মসংস্থান এত বেড়েছে যে, কৃষিকাজে শ্রমিক পাওয়াই দায়। তিনি কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর গুরুত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে এখন আর কেউ দুর্ভিক্ষের দেশ, ভিক্ষুকের দেশ মনে করে না। এখন সবাই মনে করে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। তিনি বলেন, ’৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে এমন অবস্থায় ছিল, তখন বাংলাদেশ বললে মানুষ মনে করত একটা দুর্ভিক্ষের দেশ, দুর্যোগের দেশ; এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জাতির পিতাকে হত্যার পর অনেক দেশ বলেছে তোমরা তোমাদের নেতাকে হত্যা করেছ? তখন খুনি দেশ হিসেবে আমরা পরিচিত হই। সে সময় আন্তর্জাতিকভাবে কোথাও গেলে বলত বাংলাদেশ তো হাত পাততে আসে। এখন অন্তত এটুকু দাবি করতে পারি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিটা পরিবর্তন হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দুঃশাসন, নিপীড়ন-নির্যাতনের কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এ অফিসে ঢুকতে দিত না, চারদিকে পুলিশি ব্যারিকেড দেওয়া ছিল। অনেক সময় নেতা-কর্মীরা আটকা পড়ত, তখন আমি বাধ্য হয়ে জোর করে ঢুকতাম এবং নেতা-কর্মীদের উদ্ধার করতাম। ২০০১-এ নির্বাচনের পর আমাদের অফিসটা হয়ে গিয়েছিল হাসপাতাল। কারণ বিভিন্ন জেলা থেকে আহত নেতা-কর্মীরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। নেতা-কর্মীদের চিকিৎসাব্যবস্থা, খাওয়ার ব্যবস্থা আমরা এখানে করেছিলাম। তিনি বলেন, ’৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর আমাদের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা হয়েছে।

নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলা করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন যাতে না হয় অনেক চক্রান্ত ছিল, অনেক ষড়যন্ত্র ছিল। সেই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই আমরা নির্বাচন করেছি। তিনি বলেন, যে দল নির্বাচন করে না, তারা তো গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচন করায় অভ্যস্ত না। যেসব জরিপ আন্তর্জাতিকভাবে হয়েছিল তাতে স্পষ্ট ছিল বিএনপি নির্বাচন করলে কখনো সরকার গঠন করার মতো সাফল্য অর্জন করবে না। সে রকম সিটও তারা পাবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বেলায় সার্ভে ছিল, শুধু একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। আওয়ামী লীগ পর্যাপ্ত সিট পাবে। এ কথা শোনার পর তারা (বিএনপি) নির্বাচনে আসবে না, এটা তো স্বাভাবিক। তা ছাড়া ওদের সৃষ্টি হয়েছিল অবৈধভাবে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তাদের পকেট থেকে। তারা জানে ক্ষমতায় বসেই নির্বাচন করতে। জনগণের ভোট চুরি করা, নির্বাচনে কারচুপি করা, এসব কালচার বিএনপির আমলেই সৃষ্টি। তারা ওটাই ভালো বুঝত।

প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, বিএনপির আগের চরিত্র দেখলাম ২৮ অক্টোবর। সেখানে পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশকে পিটিয়ে মেরেছে। ২০১৩ সালেও এভাবে মেরেছিল। সেই একই চিত্র আমরা আবার দেখলাম। তারা বলে ওখানে উসকানি দেওয়া হয়েছিল। যে অঞ্চলে পুলিশকে মারল সেখানে আওয়ামী লীগের কেউ ছিলই না। ওরাই পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ঢুকে অ্যাম্বুলেন্সে হামলা চালায়। গাড়ি পোড়ায়। প্রধান বিচারপতির বাড়ি, জাজেস কোয়ার্টার, সাংবাদিক, কেউ ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তিনি বলেন, আমাদের মহিলারা মিছিল নিয়ে আসছিল, তাদের ওপর আক্রমণ করে। এ ঘটনা ঘটিয়ে তারা (বিএনপি) আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে কাঁদে। তাদের মুরুব্বিদের কথামতো আবার কান্নাকাটি। তারা বলে সেটা উসকানি, আসলে উসকানিটা দিল কে? উসকানি দেওয়ার মতো তো কেউ ছিল না। পুলিশ তখন যথেষ্ট সহনশীলতা দেখিয়েছে। এরা এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটাবে, ঘটাতেই থাকবে। দুর্নীতি করা আর মানুষ খুন করা, এটাই হচ্ছে বিএনপির চরিত্র। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। দ্রব্যমূল্য মানুষের এখন কষ্টের কারণ, এমনটা স্বীকার করে সরকারপ্রধান বলেন, এখন মানুষের সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে দ্রব্যমূল্যে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আমরা সেটা অনেকটাই কমিয়ে এনেছি। এখানে কিছু মহল আছে। একটু চক্রান্ত করেই মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। তবে এটাও সত্য যে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে এতটা ছিল না। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছি। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টিসিবি থেকে পারিবারিক কার্ড করে দিচ্ছি। এ কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে পণ্য কেনার সুযোগ করে দিয়েছি। মানুষ যেন কষ্ট না পায়। তিনি বলেন, সামনে রোজা। এ রোজার সময়ে যা যা দরকার তার সবই আগাম কেনার ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা রমজানে হতদরিদ্রদের বিনা পয়সায় খাদ্য দিয়ে থাকি। সে ব্যবস্থাও আমরা করব। ওএমএস চালু থাকবে। মানুষের যাতে কিনতে অসুবিধা না হয় সেই ব্যবস্থাটা আমরা করব। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির রাশ যাতে আরও টেনে ধরা যায় সেজন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খাদ্য উৎপাদনে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তার পরও কিছু জিনিস বিদেশ থেকে কিনতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী যেখানে অর্থনৈতিক মন্দা, আমরা তা থেকে দূরে নই। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তবে যে জিনিসগুলো আমদানি করতে হয় যেমন গম, ভুট্টা এগুলো আমরা উৎপাদন করি। চাষ আমাদের বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এ পণ্যগুলো আমাদের আবহাওয়ার সঙ্গে এতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার পরও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, স্যাংশন-কাউন্টার স্যাংশনের ফলে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পণ্য পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পরও আমরা থেমে নেই। আমরা রিজার্ভের টাকা খরচ করে সেগুলো নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছি।

 

 

 

সর্বশেষ খবর