বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভোটের পরও ভয়াবহ হিংস্রতা

♦ থামছে না আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র বনাম নৌকা সমর্থকদের লড়াই ♦ সারা দেশে নিহত ১৫ আহত ২ হাজার ২০০, গুলিবিদ্ধ ১০০ ♦ হামলা লুট আগুন ৩৫০ ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ♦ ইসিতে ১০৫১ মামলা, চ্যালেঞ্জে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো

সাখাওয়াত কাওসার ও রফিকুল ইসলাম রনি

ভোটের পরও ভয়াবহ হিংস্রতা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভয়াবহ সহিংসতায় উত্তাল ছিল সারা দেশ। নির্বাচনের ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও থামেনি সহিংসতার মাত্রা। রূপ নিচ্ছে রীতিমতো হিংস্রতায়। নির্বাচনের পর মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের অন্তত ৩৯ জেলায় সংঘর্ষ ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৫ জন নিহত, ১ হাজার ২০০ জনের বেশি আহত, ১০০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া ৩৫০টির বেশি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক এসব সহিংস ঘটনার লাগাম টানা সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে এর চরম মূল্য দিতে হবে। সৃষ্টি হতে পারে ভয়াবহ রকমের সামাজিক অস্থিরতার। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নেপথ্য ইন্ধনদাতা ও অপরাধীদের বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভয়াবহ সহিংসতায় উত্তাল ছিল সারা দেশ। ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ জেলায় নির্বাচন ঘিরে সংঘর্ষ, সংঘাত, হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট ঘটেছে। তবে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার মাত্রা ছিল আরও তীব্র। গতকাল এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব ইউনিটে। দলীয় পরিচয় দেখে অপরাধী শনাক্ত করা হবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা করা হলে কোনো ছাড় নেই। সে যে-ই হোক না কেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনপূর্ব এবং নির্বাচনোত্তর সহিংসতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি। তাতেও উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো একটি নির্দিষ্ট দল কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করাই সহিংসতার মূল কারণ। এসব ঘটনায় নির্মম মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। আহত ২ হাজার ২০০ জনের মধ্যে ১০০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ। ৩৫০টির বেশি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট করেছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকরা। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় দেশের অন্তত ৩৯ জেলায় সংঘর্ষ ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত পাঁচজন নিহত, ৪৫০ জনের বেশি আহত, ৬০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ এবং ৩০০টির বেশি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট ঘটেছে।

ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা ১০৫১, ৭৮৪টিতে জরিমানা : ভোটের মাঠে বিভিন্ন অপরাধে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ১ হাজার ৫১টি মামলা হওয়ার তথ্য দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে আচরণবিধি ভঙ্গে ৭৪৬ জনকে শোকজ, ৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে ২৮ নভেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকা ৩ সহস্রাধিক নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম তাৎক্ষণিক বিচারে এসব জরিমানা ও সাজা দিয়েছেন। সংস্থাটির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, এসব মামলার মধ্যে ৭৮৪টিতে ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বাকি ২৬৭ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১১১টি মামলা হয়েছে বিভিন্ন থানা ও আদালতে।

যত ঘটনা : ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন কমপক্ষে ৫০টি সহিংসতায় মুন্সীগঞ্জ, বরগুনা ও কুমিল্লায় নিহত হয়েছেন তিনজন এবং ১৫০-এর অধিক আহত হয়ছেন। এর মধ্যে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনের প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট ও প্রিসাইডিং অফিসাররাও আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এদিন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৩০ জনের অধিক সাংবাদিক আক্রমণ, লাঞ্ছনা ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাই, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। মঙ্গলবার রাতে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মাত্রাইয়ে আওয়ামী লীগের নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কাঁচি মার্কার সমর্থিত কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সাতজন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজনকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। নেত্রকোনা-৩ আসনে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইফতিকার উদ্দিন তালুকদারের কর্মী-সমর্থকরা মিছিল বের করলে তাতে হামলা চালানো হয়। হামলার অভিযোগ ওঠে প্রতিপক্ষ কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এতে আহত হয়ে পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন মারা যান। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার আরেক ঘটনায় ১৪ জানুয়ারি নোয়াখালীতে একজন মারা গেছেন। নোয়াখালী-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করা আতাউর রহমান ভূঁইয়ার একজন পোলিং এজেন্টকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই প্রার্থী। এর আগে ঝিনাইদহে একজন আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হয়েছেন। গণমাধ্যমের খবর, নিহত ঝিনাইদহ-২ আসনে পরাজিত নৌকার প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকীর সমর্থক। নির্বাচনের পর গত দেড় সপ্তাহে সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় ২ শতাধিক সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে অন্তত ২০০ মানুষ আহত হয়েছে বলছে দেশের গণমাধ্যমগুলো। কুষ্টিয়া-৪ আসনের খোকসায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা চরম রূপ নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের সমর্থকরা। সর্বশেষ মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় বাড়ি ভাঙচুর, গরু ও নগদ টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদারীপুর-৩ আসনে (কালকিনি-ডাসার-সদরের একাংশ) ঈগল প্রার্থীর বিজয় মিছিলে বোমা হামলায় এমারত সর্দার (৪৫) নামে এক চা দোকানি নিহত হয়েছেন।

হামলায় স্তম্ভিত রূপগঞ্জ : মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২ শতাধিক জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মামলার বাদী দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম ওরফে জাহাঙ্গীর মাস্টার। তবে নৃশংস এ ঘটনায় জড়িত কেউ গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। ওই ঘটনার পর থেকে পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে রূপগঞ্জবাসী। এলাকাবাসী বলছে, রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের ভাই সন্ত্রাসী মিজানের নেতৃত্বে এ হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। কেউ মুখ না খুললেও তাদের হাতে থাকা হামলার ভিডিও দেখিয়েছেন তদন্ত তদারক ব্যক্তিদের। ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর মাস্টার বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী (কেটলি) শাহজাহান ভূঁইয়ার পক্ষে নির্বাচনি প্রচার চালানোর কারণেই এ বর্বর হামলা ঘটিয়েছে রফিকুল এবং তার ভাই মিজানের ভাড়াটে ক্যাডাররা। বর্তমানে তিনি, তার পরিবারসহ অনুসারীরা প্রাণনাশের হুমকিতে রয়েছেন। মঙ্গলবার উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। বাইরে থাকা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর মাস্টারের গাড়িসহ অন্তত পাঁচটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। চেয়ারম্যান কার্যালয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবিও ভাঙচুর করে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। এ সময় অফিসের গোডাউনে থাকা চার বস্তা সরকারি চাল ও তিন বস্তা কম্বল নিয়ে যায় হামলাকারীরা।

বাদ ছিল না সংখ্যালঘুরাও : সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর ও বেলকুচিতে ঈগল প্রতীকে ভোট দেওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা জেলেপাড়া, ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চড়াও হয়ে প্রতিমা ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। তারা লুটপাট চালায় এবং গবাদি পশু নিয়ে যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের তাঁতীপাড়ায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ছয়টি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ৫০টি হিন্দু পরিবারকে সাত দিন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ঠাকুরগাঁও-১ আসনের তেনাই তোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট প্রদান শেষে ফেরার পথে রোশনি রায় ও জয়দেব বর্মণের ওপর হামলা হয়। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ঈগল প্রতীকের সমর্থক পিপলু সাহা ও রঞ্জন সাহাকে কুপিয়ে আহত করা হয়। ফরিদপুর ৩ আসনে স্বতন্ত্র বিজয়ী এ কে আজাদকে সমর্থন করায় মাঝিপাড়ায় বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ১৫ সংখ্যালঘুকে আহত করা হয়। গাইবান্ধা-৫ আসনে চার হিন্দু বাড়িতে হামলা করে প্রায় ৫ লাখ নগদ টাকা ও গবাদি পশু কেড়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া মাদারীপুরের কালকিনিতে বেদে এবং ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা।

তারা গণতন্ত্র আদর্শের শত্রু

টিকে থাকার লড়াই

সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা

শক্ত হাতে দমন করতে হবে

 

সর্বশেষ খবর