শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ব্যবসায়ীদের উৎকণ্ঠা কোথায়

শাহেদ আলী ইরশাদ

গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডলার সংকট সমাধানই এখন দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এসব সমস্যা অবিলম্বে সমাধান না হলে শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে, বলতে পারছেন না তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকটে ঠিকমতো শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করা যাচ্ছে না। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন, বেড়েছে খরচ। ২০২২ সালের মাঝামাঝি শুরু হওয়া ডলার সংকট, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের শিল্প ও উৎপাদন খাতে। ডলার সংকটের কারণে আমদানির ওপরে বেশ কিছু কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকও ঋণপত্র (আমদানিতে লেটার অব ক্রেডিট-এলসি) খুলতে পারছে না। এর ফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। কারণ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই আমদানি করা হয়। কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়েও জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন কারখানা মালিকরা। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে পরিবহন ও অন্যান্য খরচ। শিল্পে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর বেড়েছে কারখানায় উৎপাদন খরচ। ফলে সংকটে পড়েছে দেশি অনেক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। দেশি বাজারে একদিকে এসব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে, সেই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানি নিয়ে জটিলতায় উৎপাদন অব্যাহত রাখাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে এলসি (ঋণপত্র) খোলায় সমস্যা হচ্ছে। কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। জ্বালানি সংকটও রয়েছে। আমদানিনির্ভর হওয়ায় শিল্পের জন্য চাহিদামতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুদহার বাড়ছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, যা শিল্পের জন্য বড় সমস্যা। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে যেভাবে বেতনভাতা বাড়ানো হয়েছে, সেভাবে আমাদের রপ্তানি বাড়েনি। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমায় পর্যাপ্ত অর্ডারও পাওয়া যাচ্ছে না।’

জানা গেছে, গ্যাস সংকটের কারণে নারায়ণগঞ্জের সব টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আড়াইহাজার ও ভুলতায় কিছু কারখানা গ্যাস পেলেও তা দিয়ে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে কোন খাত কত গ্যাস পাবে তা নির্ধারণে জ্বালানিনীতি প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য এ মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডলার। এ তিন সংকট সমাধান না হলে শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে বলা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত টেক্সটাইল মিলগুলো। গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে, এলএনজি আমদানির বাড়তি খরচ মেটাতেই এ মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, ট্যারিফ বৃদ্ধির আগে এবং পরে গ্যাস সরবরাহের অবস্থা শোচনীয়ই রয়ে গেছে। বর্তমানে অসহনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এখন বাড়তি দাম দিয়েও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।’ মোহাম্মদ আলী খোকন আরও বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানোয় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে খরচ আরও বাড়বে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১০ লাখ মানুষ। উৎপাদন বন্ধ থাকলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শঙ্কা তীব্র হবে। শিল্পের স্বার্থে সরকারকে গ্যাস সরবরাহের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। কোন খাতে গ্যাস সরবরাহ করলে তার ফিডব্যাক কী পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রেখে জ্বালানিনীতি প্রণয়ন করা জরুরি।’ এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার সামীর সাত্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যবসাবাণিজ্যের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন মূল্যস্ফীতি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে অবস্থা, তা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। আর্থিক খাত অর্থনীতির মেরুদন্ড। আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে আদায় জোরদার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমে এসেছে। সাধারণ মানুষের জন্য দেশেও খাদ্য-মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। আমি আগেও বলেছি ডলারের বিনিময় হারের ব্যবধান কমিয়ে আনতে আমাদের একটি নীতিগত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। প্রবাসীরা যেন দামের কারণে হুন্ডিতে অর্থ না পাঠায়। প্রণোদনা দেওয়ার পরও প্রবাসীরা অবৈধ চ্যানেলে বেশি দরে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছে। এটা বন্ধ করতেই ডলারের বিনিময় হার যৌক্তিক করতে হবে।’

এসবের বাইরে ঘুষ, দুর্নীতি, জটিল করব্যবস্থা, অদক্ষ আমলাতন্ত্রের সমস্যা তো রয়েছেই। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপে উঠে এসেছে এসব সমস্যা। দেশের ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রায় ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও ৪৬ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতার সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। ৬৬ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী মনে করেন আগামী দুই বছর দেশে জ্বালানি সংকট প্রকট থাকবে। ৩৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন জ্বালানির ভর্তুকি তুলে নিলে ব্যবসার খরচ বাড়বে। ৫৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন ব্যাংক খাতে নজরদারি ও তদারকির অভাব রয়েছে।

 

ডলার ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলা বড় চ্যালেঞ্জ

জ্বালানি খাত নিয়ে একটি নীতিমালা প্রয়োজন

পানি বিদ্যুৎ গ্যাস সংকট সমাধান জরুরি

সর্বশেষ খবর