সোমবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ডলার বাজার হতে হবে গোষ্ঠীতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত

মানিক মুনতাসির

ডলার বাজার হতে হবে গোষ্ঠীতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

দেশের ডলারের বাজার গোষ্ঠীতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে। যার ফলে ডলার সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এ গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে না পারলে ডলারের বাজার কোনোভাবেই স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে আর্থিক খাতের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়। দেশের অর্থনীতি শাসিত হচ্ছে রাজনৈতিক গোষ্ঠীতন্ত্র দ্বারা। এটাও বন্ধ করতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারেও এ গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রভাব বিরাজমান। আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য আনতে হবে অন্যথায় নিত্যপণ্যের বাজারের সংকট কমানো যাবে না। আর নিত্যপণ্যের বাজারের সংকট সমাধান করতে না পারলে মূল্যস্ফীতির বল্গাহীনতার রাশ টানাও অসম্ভব বলে মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। গত শনিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির ক্ষতগুলো চিহ্নিত। এগুলো হলো- অর্থনীতির লেনদেনের ভারসাম্য। চলতি হিসাবে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর কারণ হলো-অতিরিক্ত দেশি-বিদেশি ঋণ নেওয়া। রপ্তানিতে স্থবিরতা। রেমিট্যান্সের হুন্ডি হওয়া। পুঁজি পাচার। এবং প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে কাক্সিক্ষত হারে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে না। এ কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। ফলে ডলারের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আবার আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর হওয়ায় ডলারের ওপর অতিরিক্তি চাপ রয়েছে। কেননা জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্য আমদানিতে প্রচুর পরিমাণ ডলার ব্যয় হচ্ছে। ২০২১-২২ সালে আমদানি ৬০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৮২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এর বিরাট উল্লম্ফন ঘটেছে। এটি মোটেও স্বাভাবিক নয়।

দেশ থেকে পুঁজি পাচার প্রসঙ্গে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ফরেনসিক অডিট করলে পুঁজি পাচারের ঘটনাগুলো বেরিয়ে আসত। পরবর্তী বছরে দেখা গেছে যে ইপিবির তথ্যমতে ১২ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ রপ্তানির অর্থ দেশে আসেনি। এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত হলে বোঝা যেত পুঁজি পাচারের ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটছে। আবার রেমিট্যান্সের অর্থ ব্যাংকিং (প্রাতিষ্ঠানিক) চ্যানেলে আসছে না। অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের রেট বেশি হওয়ায় প্রবাসীরা প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন না। এ ব্যাপারেও এখন পর্যন্ত কোনো রকম নীতিমালা করা হয়নি। নীতিমালা করা হলে ডলারের বর্তমান সংকটে পড়তে হতো না।

অব্যাহত মূল্যস্ফীতির সংকট প্রসঙ্গে তার মূল্যায়ন জানতে চাইলে অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে মুদ্রানীতির মাধ্যমে সংকট নিরসন করা যাবে না। মূল্যস্ফীতির কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। প্রথমত ভ্রান্তনীতির কারণে আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ কারণেও মূল্যস্ফীতি ঘটছে। বাংলাদেশের মুদ্রানীতির সঙ্গে যে মূল্যস্ফীতির হার দেখানো হয়েছে তা অলীক-অবাস্তব। অতীতেও যেসব লক্ষ্যমাত্রা দেখানো হয়েছে সেগুলোও বাস্তবে অর্জিত হয়নি। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের ব্যাপারে বার বার ঘোষণা দেওয়া হলেও খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি। ২০০৯ সালে যে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা তা এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ডলার ও টাকার সংকট, রিজার্ভ, খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতের অনিয়মের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত গোষ্ঠীতন্ত্র জড়িত। এর দুটি দিক রয়েছে- একটি অর্থনৈতিক, আরেকটি অর্থনীতি বহির্ভূত তথা-গোষ্ঠীবাদী বা গোষ্ঠীতন্ত্র, যারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্যাংক, অর্থনীতি, ডলারের বাজার এমনকি নিত্যপণ্যের বাজারেও এ গোষ্ঠীতন্ত্র সক্রিয়। এজন্যই ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় প্রসঙ্গে ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাজারের সিন্ডিকেটকে ভাঙতে হবে। গোষ্ঠীতন্ত্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। এখানে কোনো জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নেই। সেটাতে কঠোর নজরদারি করতে হবে। খাদ্য শস্যের আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য আনতে হবে। কোনো একক দেশের ওপরে নির্ভরতা এবং ওই দেশের নীতি নির্ধারণের একচেটিয়া প্রভাব বৃদ্ধি পায় এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।

একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে দাম কমে না। যেমন খাদ্য শস্যের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ দাম কমলেও বাংলাদেশের ভোক্তা পর্যায়ের দামের কোনো সুবিধা পাওয়া যায়নি। বরং খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপ ঊর্ধ্বমুখীই রয়েছে। বার বার হুমকি-ধমকি এবং দাম নির্ধারণ করে দিলেও কোনোভাবেই বাজারের ওপর প্রভাব ফেলা সম্ভব হয়নি। এতে ভোক্তা পর্যায়ে কোনো সুবিধার ঘটনাও ঘটেনি। অন্যদিকে অধিকাংশ তথ্য গরিব, নিম্ন আয়, নির্দিষ্ট আয় এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। যার ফলে অধিকাংশ মানুষ খাদ্যাভ্যাস কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব একটা গোষ্ঠীর ওপর পড়েছে। যার ফলে ঢাকা বিভাগসহ অনেক স্থানে দারিদ্র্য বেড়েছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঠিক করতে হলে প্রকৃত তথ্যের প্রয়োজন। যেসব ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য দরকার যেসব ক্ষেত্র ভুল ও অপতথ্যে সয়লাব। সঠিক তথ্য না থাকলে বা পরিসংখ্যানে স্বচ্ছতা না থাকলে সঠিক নীতি প্রণয়ন করা যায় না। বানানো তথ্যের ওপর গল্প বা ন্যারেটিভ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সংকট গভীরতর হয়। আমাদের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।

নেতিবাচক ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং রিজার্ভের পতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের এখানে বড় রকমের পেমেন্ট ক্রাইসিসের আঘাত আসছে। যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ভারসাম্যকে বিঘিœত করছে। বৈদেশিক ঋণ ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সালে ৩১২ শতাংশ বেড়েছে কিন্তু বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত আফনিস্তানের ওপরে আছে বাংলাদেশ।

প্রাপ্ত আয় যেটুকু বেড়েছে তা মূলত বৈদেশিক মুদ্রার ৩০ অবচয়ের কারণে ঘটেছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এটা ঘটেছে। অর্থাৎ রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় আয়কর বাড়ানো হয়নি। কর ফাঁকি এবং কর জালিয়াতি বিদ্যমান রয়েছে এবং গোষ্ঠীতন্ত্রের বিবেচনায় বিশাল আকারের কর সুবিধা জারি রয়েছে।

অর্থনীতির সংস্কারের কথা টেনে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সমস্যা কাঠামোগত। এখানে শক্তিশালী গোষ্ঠীতন্ত্র অর্থনীতিতে সুবিধাভোগী। কাঠামোগত সংস্কার বর্তমান সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। বর্তমান বিদুু্যুৎ ও গ্যাসের যে সংকট চলছে তাতে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গোষ্ঠীতন্ত্রকে সুবিধা দেওয়া চলমান রয়েছে। একইভাবে জ্বালানির জন্য অনুসন্ধান না করে আমদানিনির্ভরতা বজায়মান।

জ্বালানি খাতের সংকট নিরসনে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একদিকে দায় মুক্তি প্রাপ্ত রেন্টাল কুইক রেন্টাল থেকে ডলার দিয়ে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানিনির্ভরতার মাধ্যমে জ্বালানি খাতকে আরও সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে বিপুল পরিমাণ ডলার ব্যয় হচ্ছে। এ ধরনের আমদানিনির্ভরতার সঙ্গে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি লোহিত সাগরের মতো হলে জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। এতে কৃষি, শিল্প খাতের উৎপাদন খরচ ও যোগাযোগ সব খাতেরও ব্যয় বেড়েছে এবং আরও বাড়বে। এ কারণেই উৎপাদনকারী বিশেষ করে কৃষকরা সঠিক মূল্য পান না। এ অবস্থা চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতির বল্গাহীনতার রাশ টানা যাবে না। বাংলাদেশের সামষ্টিত অর্থনীতিতে যেমন অস্থিরতা যুক্ত হয়েছে। তার সঙ্গে আরও তিনটি নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। প্রথমত খাদ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কেননা খাদ্যের বাজারেও গোষ্ঠীতন্ত্রের দৌরাত্ম্য ভর করেছে। যা সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। দ্বিতীয় জ্বালানির ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় এ খাতেও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তৃতীয়ত পার্শ¦বর্তী দেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটজনিত ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে মিয়ানমারে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্যাদির পাচার বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে মিয়ানমার থেকে মাদকসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। জান্তা সরকারের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে একটা গোষ্ঠী এখানে মাদক ঢুকিয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে আমাদের নিত্যপণ্য নিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

সর্বশেষ খবর