মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সোনা চোরাচালানে অস্ত্রবাজি

♦ হচ্ছে গোলাগুলি বাড়ছে মৃত্যু ♦ চালান আটক হয় বন্ধ হয় না কোনো কিছু

নিজস্ব প্রতিবেদক

সোনা চোরাচালানে অস্ত্রবাজি

বাংলাদেশ-ভারতের চার জেলা সীমান্তে সোনা চোরাচালান ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত ঘটছে বন্দুকযুদ্ধ। একই রেশে কয়েকদিন আগে ঝিনাইদহে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে দুজনকে। এদিকে কলকাতায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) মাঝেমধ্যে আটক করছে শত শত কোটি রুপি। পশ্চিমবঙ্গের একজন মন্ত্রী ও তার বান্ধবী আটক হয়েছিলেন দুর্নীতির দায়ে। কিন্তু সোনার চালান আটক হলেও বাংলাদেশের রাঘববোয়ালরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের চিহ্নিত করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত কেবল বহনকারীই আইনের আওতায় আসে। মূল হোতারা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া ও চোরাচালানে জড়িত গডফাদারদের আইনের আওতায় আনতে না পারার জন্যই সোনা চোরাচালান বাড়ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গডফাদারদের আটক করতে পারলেই সোনা চোরাচালান রোধ করা সম্ভব হতো। অথচ পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির দায়ে সাবেক শিল্পমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

সীমান্ত সূত্রগুলো বলছেন, দুবাই, মালয়েশিয়া, আফ্রিকা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানে দেশে আসে সোনার চালান। পরে ঢাকা থেকে ট্রেন অথবা বাসে করে একটি গ্রুপ সোনা নিয়ে যায় দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায়। সীমান্তে নির্ধারিত স্থানে সোনার চালানটি হাতবদল হয়ে চলে যায় স্থানীয় এজেন্টের হাতে। স্থানীয় এজেন্টরা সেই সোনার চালান সীমান্ত পার করে পৌঁছে দেয় ভারতে। সোনার বিক্রির টাকায় এপারে আসে মাদকদ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান পণ্য। সোনা চোরাচালানের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব অঞ্চলে অসংখ্য গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষও ঘটে। ১৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় ‘স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে দ্বন্দ্বের জের’ ধরে গোলাগুলিতে দুজন নিহত হন। উপজেলার বাঘাডাঙ্গা গ্রামের পলিয়াটিপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন বাঘাডাঙ্গা গ্রামের শামীম ইসলাম (৩৫) ও মন্টু মন্ডল (৫০)। স্বর্ণ চোরাচালানের আধিপত্য বিস্তার নিয়েই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমন খুনোখুনির ঘটনা সীমান্ত এলাকাগুলোয় এখন অহরহ।

জানা গেছে, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে সীমান্ত রয়েছে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরায়। এর মধ্যে ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলা হয়ে সোনা চোরাচালান আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই নানা কৌশলে চোরাকারবারিরা সোনা পাচার করছে। এ ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে নিরাপদ পথ ভাবছে। জব্দ সোনার পরিসংখ্যানও দিচ্ছে সে তথ্যের প্রমাণ। দেশের সীমান্ত এলাকায় ২০১৯ সালে এক বছরে পাচারের সময় জব্দ করা হয়েছিল ৫৪ কেজি ২৩৪ গ্রাম সোনা। আর ২০২৩ সালে ধরা পড়েছে প্রায় দেড় শ কেজি। ধরা পড়া সোনার এ হিসাবই বলে দিচ্ছে, অবৈধ পথে চালান জব্দের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন গুণ। তবে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বছরে সোনা পাচার হচ্ছে এর ২০ গুণ। এসব ঘটনায় আটক করা হয় ৬৯ জনকে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা গেছে, সীমান্ত এলাকায় ধীরে ধীরে চোরাই সোনার চালান উদ্ধারের ঘটনা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে বিজিবির হাতে ধরা পড়ে ৫২৭ কেজি সোনা। আর গত ১০ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউস, বিজিবি, পুলিশ ও এয়ারপোর্ট এপিবিএন সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করে। তবে নানামুখী কার্যক্রমের পরও চোরাচালান বন্ধ হয়নি। মাঝেমধ্যে বাহক ধরা পড়লেও রাঘববোয়াল থাকছে পর্দার আড়ালেই।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈধভাবে দেশে সোনা আসার পরিমাণ খুব বেশি নয়। ডলার সংকটের এ সময়ে সোনা চোরাচালান দেশের অর্থনীতিতেও ধাক্কা লাগাচ্ছে। কারণ সোনা পাচারের অর্থ বিনিময় হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সোনা আমদানি হয়েছে ১৪৮ কেজির মতো। যদিও বছরে দেশে সোনার চাহিদা ২০ থেকে ৩০ টন। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালংকার কোনো যাত্রী দেশের বাইরে থেকে নিয়ে এলে শুল্ক দিতে হয় না। তবে একটি বার (১১৭ গ্রাম) আনলে যাত্রীকে ৪০ হাজার টাকার মতো শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। আর ব্যাগেজ রুলের আওতায় ভরিপ্রতি যাত্রীকে খরচ করতে হয় ৪ হাজার টাকা।

সীমান্ত এলাকায় দীর্ঘদিন কাজ করছেন গোয়েন্দা সংস্থার এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু ব্যবসার নামে খাটাল (গোয়াল) তৈরি করে এর আড়ালে বাহকের মাধ্যমে ভারতে সোনা পাচার করা হচ্ছে। এর বিনিময়ে ভারত থেকে সমপরিমাণ ডলার বা অন্য মুদ্রা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আনা হয়।

যেসব পথ থেকে দেশে অবৈধভাবে সোনা ঢোকে, এর একটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। অবৈধ সোনা জব্দের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় প্রায়ই মামলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু বাহক রয়েছে যারা নিয়মিত চোরাই সোনা আনা-নেওয়া করে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে এমন অনেক প্রবাসীকে চোরাকারবারিরা টোপ দেয় সোনার বার বহনের বিনিময়ে বিমানে দেশে আসা-যাওয়ার টিকিট খরচ তারা বহন করবে। আবার পেশাদার যারা এ কারবারে জড়িত, বাহক হিসেবে তারা প্রতি চালানের জন্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পায়। পাচারকারীরা অবৈধ মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করে। নাম-পরিচয়হীন এসব সিম নম্বর তাদের কাছে সরবরাহের জন্য আছে আলাদা গ্রুপ। সাধারণত ফেনী, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দাদের বাহক হিসেবে বেশি ব্যবহার করছে চক্রের সদস্যরা।

সিআইডি যশোরের একজন কর্মকর্তা বলেন, কঠোর নিয়ম মেনে ভারত সোনা আমদানি করে। তাই অনেক সময় চোরাকারবারিরা অবৈধ পথ বেছে নেয়। নানা সাংকেতিক কোড ব্যবহারের মাধ্যমে সীমান্ত হয়ে চালান বাইরে যায়। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসছে, তাদের ধরা হচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলাও হচ্ছে।

এক দশকে যশোরে ৬০ মামলা : যশোর অঞ্চলে গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বড় সোনার চালান উদ্ধার হয় ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট। শার্শার শিকারপুরে বিজিবি সদস্যরা মহিউদ্দিন নামে একজনকে আটক করে তার ব্যাগ থেকে ৬২৪টি সোনার বার জব্দ করেন, যার ওজন ছিল ৭২ কেজি ৪৫০ গ্রাম। মামলাটি তদন্ত করে সিআইডি মহিউদ্দিনসহ নয়জনের নামে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর মামলাটি সাড়ে চার বছর ধরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। আসামিদের মধ্যে মহিউদ্দিনসহ চারজন জামিনে, বাকি পাঁচজন এখনো পলাতক। গত এক দশকে সোনা আটকের ঘটনায় যশোরে অন্তত ৬০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার অর্ধেকের বেশি বিচারাধীন। আবার বেশির ভাগ আসামি জামিনে রয়েছে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর