বুধবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

হাইওয়ে এখন গ্রামীণ সড়ক

♦ ঢাকা-চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে চলছে অটোরিকশা থ্রি-হুইলার নসিমন করিমন ভটভটি ♦ ঘটছে দুর্ঘটনা ♦ হাটবাজার আর বেপরোয়া যানবাহনে স্থবিরতায় যানজট

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাইওয়ে এখন গ্রামীণ সড়ক

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ অবৈধ যানবাহন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ৮৫ শতাংশের বেশি পরিচালিত হয়। কিন্তু ২৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়ক প্রয়োজনের তুলনায় সম্প্রসারণ না হওয়া, যত্রতত্র হাটবাজার, অবৈধ ও ধীরগতির যান চলাচল, উল্টোপথে যান চলাচল, অপরিকল্পিত ইউটার্নসহ

নানা অব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কটি পরিণত হয়েছে ‘লোকাল সড়কে’। ফলে ব্যাহত হচ্ছে পণ্য আমদানি-রপ্তানি। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সময় ও জ্বালানি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে দ্রুত সময়ের মধ্যে আট লেনে উন্নীতকরণ এবং ডেডিকেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম থেকে আমাদের সংবাদকর্মী মুহাম্মদ সেলিম ও আজহার মাহমুদ জানান, দেশের জিডিপির ৫০ শতাংশই ঢাকা ও চট্টগ্রাম ঘিরে আবর্তিত। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার কেন্দ্রিক নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে এ মহাসড়কের ওপর চাপ ও এর গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। অথচ যত্রতত্র সড়ক দখল, অবৈধ হাটবাজার, পার্কিং, উল্টোপথে যান চলাচল, অপরিকল্পিত ইউটার্ন এবং প্রয়োজনীয় ওভারপাস-আন্ডারপাস না থাকায় মহাসড়কের বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে সড়কটি। মহাসড়কের ২৫৬ কিলোমিটারের দুই পাশে বাজার রয়েছে ২৭টি। এর মধ্যে ১০টির অধিক বাজারে যানজট নিত্যসঙ্গী। ওই বাজারগুলোয় পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার ভিড়, বাজার এলাকায় ট্রাক, ভ্যান, সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা এবং লোকজনের মহাসড়কের ওপর দিয়ে চলাচলের কারণে যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়িগুলোর গতি নামিয়ে আনতে হয় ঘণ্টায় ১০-১৫ কিলোমিটারে। এর চাপ পড়ে মহাসড়কজুড়ে। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় ওভারপাস কিংবা আন্ডারপাস না থাকায় তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। মহাসড়কের সীতাকুণ্ড, ভাটিয়ারী, বাড়বকুণ্ড, মিরসরাই, বারইয়ারহাট, চৌদ্দগ্রাম বাসস্ট্যান্ড, চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড, নিমসার বাজার, পদুয়ার বাজার, মদনপুর মোড়, সোনারগাঁ মোড়, গৌরীপুর বাজার, ইলিয়টগঞ্জ বাজার, মাধাইয়া বাজার, গজারিয়া ভবেরচর, সোনারগাঁ, সাইনবোর্ড, শিমরাইল, কাঁচপুরে যানজট এ মহাসড়কের সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

এ ছাড়া মহাসড়কের অর্ধশতাধিক ইউটার্নে গাড়ি ঘোরানোর সময় যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটলে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামের সিটি গেট থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় সড়ক দখল করে অবৈধ পার্কিং, সড়কের পাশ ঘেঁষে দোকান নির্মাণের ফলে প্রায়ই যানজট তৈরি হচ্ছে। মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা ও ধীরগতির যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ হলেও মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফেনী, কুমিল্লাসহ অনেক এলাকায় চলছে এসব যানবাহন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন ম্যানেজ করে এসব নিষিদ্ধ যানবাহন সড়ক দাপিয়ে বেড়ায়। আবার কিছু এলাকায় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে এবং যাত্রাপথ কমিয়ে আনতে সিএনজি অটোরিকশা ও অবৈধ যানবাহনের চালকদের উল্টোপথেও যানবাহন চালাতে দেখা যায়। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ মহাসড়কের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েও বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। মহাসড়কের নিরাপত্তার জন্য এলাকাভেদে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা নিয়োজিত থাকলেও হামেশাই ঘটছে ডাকাতি ও ছিনতাই। ৫ জানুয়ারি মহাসড়কের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড অংশে দুর্বৃত্তরা ধারালো লোহার পাত ছিটিয়ে দেওয়ায় অন্তত ৩০টি যানবাহনের চাকা ফেটে যায়। এ ব্যাপারে মোস্তাফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক সরোয়ার আলম বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে চট্টগ্রাম ঘিরে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বে-টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, প্রতিবেশী দেশের ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট চালু হলে এ মহাসড়কের গুরুত্ব বেড়ে যাবে বহুগুণ। তাই দ্রুত এ মহাসড়কে এক্সপ্রেসওয়ে করা প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির পাইপলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের গুরুত্ব বাড়বে বহুগুণ। তাই আলাদা কন্ট্রোল এক্সসেস এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি এখন সময়ের দাবি।’

হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার খাইরুল আলম বলেন, ‘মহাসড়ক থেকে বাজার সরানো এবং অবৈধ যান চালাচল বন্ধের অভিযান নির্বাচনের সময় বন্ধ ছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা ফের চালু করা হবে।’

উল্টোপথে চলছে গাড়ি : আমাদের ফেনী প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে উল্টোপথে দেদার চলাচল করছে বিভিন্ন ধরনের বৈধ ও অবৈধ পরিবহন। ফেনী সদর উপজেলার শশর্দী ইউনিয়ন থেকে ছাগলনাইয়া উপজেলার ধুমঘাট পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার মহাসড়কের পুরো অংশেই উল্টোপথে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। উল্টোপথে চলাচলরত গাড়িগুলোর কারণে সঠিক পথে চলাচলরত গাড়িগুলোও পড়ছে বিপাকে। গতি কমিয়ে দিতে হচ্ছে। এতে সময় অপচয়ের পাশাপাশি অপচয় হচ্ছে জ্বালানির। মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী ট্রাকচালক মো. শহীদ বলেন, ‘হঠাৎ সামনে উল্টোপথে আসা গাড়িগুলো দেখার পর অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। লোড গাড়ি অল্প জায়গায় ব্রেক করে থামানো যায় না। আবার অনেক সময় ডান পাশ কেটে সাইডে যাওয়ার সুযোগও হয় না।’ হাইওয়ে পুলিশের ওসি মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘ফেনীতে মোট ফিডার রোড ৪৭টি। এসব রোড থেকে গাড়িগুলো হঠাৎ মহাসড়কে উঠে পড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি মহাসড়কে যেন অনুমোদনহীন গাড়ি চলতে না পারে। প্রতিদিন আমরা ১০-১৫টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছি। কিন্তু সব সময় সব গাড়ি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। এ ছাড়া শহরের তিনটি সড়ক থেকে আসা গাড়িগুলো উল্টোপথ দিয়ে মহাসড়কের কিছু অংশে চলাচল করতে দেওয়ার জন্য জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সিদ্ধান্ত আছে।’

অবৈধ অটোরিকশায় দুর্ঘটনা : দাউদকান্দি (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দির অংশে অবৈধ অটোরিকশার কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ১৯ অক্টোবর মহাসড়কের দাউদকান্দির জিংলাতলীতে অটোরিকশা ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় অটোরিকশার তিন যাত্রীই নিহত হয়। বাসটিও পাশের পুকুরে পড়ে যায়। এসব অটোরিকশা চালকের অনেকেই শিশু। বয়স ১০ থেকে ১১ বছরের মধ্যে। দাউদকান্দি হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশের সার্জন মোজাহিদ বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মহাসড়কে টহল দিচ্ছি, যারা মহাসড়কে অটোরিকশা নিয়ে আসে তাদের জরিমানাও করছি, মামলা দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হঠাৎ যখন মহাসড়কে উঠে উল্টোপথে চলে, তখনই দুর্ঘটনা ঘটছে।’

চাঁদা দিয়ে মহসড়কে অবৈধ থ্রি হুইলার : আমাদের নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ থ্রি হুইলার। মহাসড়কের দুই পাশে প্রতিটি গলির মুখে রয়েছে এ নিষিদ্ধ যানের স্ট্যান্ড। দূরত্ব কমাতে বেশির ভাগ সময় এসব অবৈধ যানবাহন মহাসড়কে উঠে উল্টোপথে চলছে। যত্রতত্র হঠাৎ থামিয়ে যাত্রী তুলছে। এতে একদিকে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, ঘটছে দুর্ঘটনাও। অভিযোগ রয়েছে, হাইওয়ে পুলিশের একটি অসাধু চক্র মহাসড়কে এসব নিষিদ্ধ যান চলাচলের সুযোগ দিয়ে মাসে কোটি টাকা চাঁদা তুলছে। পুরো মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে এ চাঁদা উত্তোলনে রাখা হয়েছে লাইনম্যান। এমনকি চাঁদার বিনিময়ে মহাসড়ক ঘেঁষে দোকান দেওয়ার সুযোগও করে দেওয়া হচ্ছে। এতে পুলিশের পাশাপাশি জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালীরা। গতকাল দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কের শিমরাইল মোড়, সাইনবোর্ড, কাঁচপুর, মদনপুর, মোগরাপাড়া, তারাব, ভুলতা, গাউছিয়া ও কাঞ্চনে প্রশাসনের নাকের ডগায় শত শত ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজি, লেগুনা অবাধে চলাচল করতে দেখা যায়। খোদ কাঁচপুর ব্রিজের ওপর দিয়ে উল্টোপথে অটোরিকশা চলতে দেখা যায়। এসব যানের অধিকাংশ চালকই শিশু। একই অবস্থা রূপগঞ্জের ভুলতা-গাউছিয়া এলাকার মহাসড়কে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর