সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সংসদে স্বতন্ত্র হিসেবেই ভূমিকা

সন্ত্রাস দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকবে, স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থী ঠিক করার দায়িত্ব দিলেন স্বতন্ত্ররা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংসদে স্বতন্ত্র হিসেবেই ভূমিকা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবেই ভূমিকা পালন করতে নিদের্শনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬২ জন সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে এমন নিদের্শনা দেন তিনি। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা দলে যোগদানের দাবি জানালেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,  আপনারাও আমার, সরকারি দলও আমার। অর্থাৎ ডান হাতও আমার, বাম হাতও আমার। আপনারা রিজার্ভ ফোর্স থাকুন। সংসদে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবেন, আবার উন্নয়নও তুলে ধরতে পারবেন। দুই সুবিধাই আপনারা পাবেন। আবার দল থেকেও তো কাউকে বহিষ্কার করা হয়নি। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সংসদ সদস্য এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে বৈঠক শেষে গণভবনের গেটে দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা স্বতন্ত্রই থাকবেন। তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবেন। এই একটা বিষয় আমাদের সংসদ নেতা, দলের সভানেত্রী পরিষ্কারভাবে বলেছেন।’ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা তাদের অনুকূলে সংরক্ষিত আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অর্পণ করেছেন। ওই আসনে প্রধানমন্ত্রী যাদের মনোনয়ন দেবেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা তাতে সমর্থন জানাবেন। এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তাতে প্রধানমন্ত্রীর সায় মেলেনি। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বৈঠক শুরু হয়। প্রথমে প্রায় ৪০ মিনিট সূচনা বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে রুদ্ধধার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে স্বতন্ত্র ৬২ জন সংসদ সদস্য অংশ নেন। সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আপনারা আজকে গণভবনে এসেছেন। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আমি সারা জীবন জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকারে লড়াই করেছি। আপনারা নির্বাচিত হয়ে ঘরের মানুষ ঘরে ফিরলেন। শেখ হাসিনা বলেন, কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতিকে আশ্রয় দেওয়া যাবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে। গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদর সঙ্গে বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হবে এবং সংবিধান আত্মস্থ করতে হবে। সংসদ কার্যপ্রণালি বিধি পড়তে হবে। আমাদের সংসদ ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ পার্লামেন্ট। কাজেই সংসদ প্র্যাকটিস ভালো করে জানতে হবে।  দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব প্রকল্প দেশের মানুষের জন্য অর্থবহ সেসব প্রকল্পই গ্রহণ করা হয়। স্বতন্ত্র এমপিদের নির্বাচনি এলাকায় যদি কেউ ভূমিহীন, গৃহহীন থাকেন, তাদের জন্য ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে। অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। বৈঠক সূত্র জানান, প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের মধ্যে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্র হ্যাটট্রিক বিজয়ী মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন, নেত্রী সামনে সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন রয়েছে। আমরা (স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা) যতগুলো সংরক্ষিত নারী আসন পাই, আমরা নারী আসন নেব না। আপনাকে দায়িত্ব দিচ্ছি। আপনিই ঠিক করে দেবেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা যখন নিজেরাই দিচ্ছেন, তখন আমার জন্য ভালো হলো। কারণ দলের অনেক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নারী রয়েছেন, তাদের পর্যায়ক্রমে মূল্যায়ন করা হবে। গাজীপুর-৫ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি আখতারুজ্জামান বলেন, নেত্রী আপনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। আপনার বহু ছবি আমি দেখেছি। কিন্তু সবচেয়ে গর্বের ছবি, আমার কাছে বিশ্বব্যাংকের প্রধানের হাতে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ছবি। এ সময় পদ্মা সেতু নিয়ে শেখ হাসিনা দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা করেন। বরিশাল-৪ আসনের স্বতন্ত্র নির্বাচিত সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন, নেত্রী আমার এখানে তো নৌকা ছিল না। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছি। আমাকে নৌকায় নিয়ে নেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেভাবে আছ, সেভাবেই থাক। কুমিল্লা-২ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ বলেন, নেত্রী আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমি স্বতন্ত্র নির্বাচিত হলেও নৌকার সঙ্গে থাকতে চাই। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আপনাকে কি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে? আপনি তো আওয়ামী লীগেই আছেন। দলের সব সুযোগ-সুবিধাই পাবেন। আপনারা আমার রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে থাকুন। ডান হাতও আমার, বাম হাতও আমার। আপনারা সরকারের সমালোচনাও করবেন, উন্নয়নও তুলে ধরবেন। কুমিল্লা-৪ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাজ আজাদ প্রধানমন্ত্রীকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করায় ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত দেশকে নিয়ে অনেক বড় চক্রান্ত করেছিল। আপনার বুদ্ধিমত্তার কাছে তারা পরাজিত হয়েছে। এ সময় তিনি কুমিল্লা নামে বিভাগ দাবি করেন। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, কুমিল্লা নামে বিভাগ অন্যরা চায় না।  নীলফামারি-৩ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সাদ্দাম হোসেন পাভেল তার বক্তৃতার সময় নির্বাচনি এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের যে নির্মম সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন সে চিত্র তুলে ধরেন। এরপর তিনি বলেন, স্বতন্ত্র নির্বাচন করার সুযোগ দিয়েছেন, তাই নির্বাচিত হয়ে এসেছি। আমি আপনার লোক। ঢাকা-৫ আসনের স্বতন্ত্র নির্বাচিত এমপি মশিউর রহমান মোল্লা সজল বিশ্ববাসীকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য খসরু চৌধুরী বলেন, আমাদের গায়ে যদি এখনো স্বতন্ত্রের সিল থাকে, তাহলে দলের পদে থেকে কাজ করতে আমাদের অসুবিধা হবে এবং এখনো হচ্ছে, বিভিন্ন কথা বলছে। সে ক্ষেত্রে আপনার (প্রধানমন্ত্রী) মতামত কী হবে? গণভবন থেকে বের হয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, দ্বাদশ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিভিন্ন মার্কার কিছু সংঘাত, সহিংসতা, অন্তকলহ, এসব বিষয় রয়েছে। কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে অবাঞ্চিত ঘটনা ঘটছে। এরকমটি আর হতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, তারা (স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য) দাবি করেছে আওয়ামী লীগেই থাকতে চায়। ভিন্ন কোনো নামে পরিচয় দিতে গেলে তাদের বিবেক-আবেগ আহত হয়। তিনি বলেন, নিজেরা নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহ বিভেদ মিটিয়ে ফেলতে হবে। নির্বাচন ইশতেহার বাস্তবায়নে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, নারী সংরক্ষিত আসনের ব্যাপারে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা যাদের মনোনীত করবেন তাদের প্রতি স্বতন্ত্রদের সমর্থন থাকবে, তারা ব্যক্ত করেছেন। স্বতন্ত্র এমপিরা কোন হুইপের আওতায় থাকবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিফ হুইপ সংসদ নেতার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয়লাভ করে। এর বাইরে এবার ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে জিতেছেন, যাদের মধ্যে ৫৮ জনই সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। তারা সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতা। এদের মধ্যে দলের অনেক ত্যাগী নেতাও রয়েছেন। এর আগে গত ১০ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের শপথ গ্রহণের পরপরই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা তাদের সংসদীয় দলের সভা করেন। ওই সভায় শেখ হাসিনাকে সংসদ নেতা নির্বাচন করা হয়। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের অবস্থান কী হবে, বৈঠকে সেটি নিয়েও আলোচনা হয়।

সর্বশেষ খবর