কুমিল্লার সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর অনিয়ম-দুর্নীতিতে বারোটা বেজেছিল সিটি করপোরেশনের। নওয়াব ফয়জুন্নেসা, শচীন দেববর্মণ, কবি নজরুল, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার ঐতিহ্যের সর্বনাশ ঘটিয়ে তার শাসনামলে পরিণত করা হয়েছিল যানজট, অপরিচ্ছন্ন ও দুর্নীতি-অনিয়মের শহরে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় নিজের ৭৮টি ফ্ল্যাট থাকার ঘোষণা মিডিয়ার সামনে নিজেই দিয়েছিলেন সাক্কু। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তাঁর অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে খোদ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। গত ২২ জানুয়ারি দুদক সচিব বরাবর পাঠানো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সাক্কুর অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। এই চিঠির স্মারক নম্বর- ৪৬.০০.০০০০.০৭০.২৭.০০১.২০-৭৩। এদিকে দীর্ঘদিন থেকে কুমিল্লা শহরে সাক্কুর কাছের মানুষ হিসেবে খ্যাত সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন (বাহার) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া এক চিঠিতে সাক্কুর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন। গত ১৪ জানুয়ারি এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবরে এই চিঠি দেন এমপি বাহার। একই দিন সাক্কুর অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও চিঠি দেন তিনি। চিঠির সঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর বক্তব্যের সংবাদ কার্টিং ও অডিও রেকর্ড সংযোজন করে দেন এমপি বাহার। এনবিআর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে এমপি বাহারের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর আমলে যেসব ভবনের প্ল্যান অনুমোদন করা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই আইন না মেনে বিশাল অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে অনুমোদন দিয়েছেন তিনি। এমনও খবর রয়েছে, কয়েকটি আলোচিত বহুতল ভবনের প্ল্যান অনুমোদনের জন্য ৮৫ লাখ, ৮০ লাখ, ৬০ লাখ ও ৪০ লাখ টাকাও ঘুষ নিয়েছেন তিনি। গড়ে প্রতিটি ভবনের প্ল্যান পাশের জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।’ চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘টাকা নিয়ে নির্মাণাধীন ভবনের প্ল্যান পাস করা ছাড়াও কোথাও কোথাও বেআইনিভাবে শুধুমাত্র মৌখিক অনুমতি দিয়ে কিংবা দরখাস্তের ওপরে একক ক্ষমতাবলে ভবন নির্মাণ কিংবা পাইলিং করার অনুমতি দেন তিনি (সাক্কু)। যা মেয়রের এখতিয়ার ও কর্তৃত্ব বহির্ভূত ক্ষমতার অপপ্রয়োগ।’ এ ছাড়া ‘প্রতি বছর ড্রেন পরিষ্কারের নামে ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হলেও সিটি করপোরেশনের সব মেশিনারিজ ও লোকবল ব্যবহার করেই ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। বিনিময়ে তিনি দরপত্রের এই টাকা আত্মসাৎ করেন।’ চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রতি বছর বিভিন্ন কোটেশনের মাধ্যমে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার অনেক কাজ না করেও তিনি আত্মসাৎ করেন। তার নিজ নামে কোনো ঠিকাদারি লাইসেন্স না থাকলেও সব ঠিকাদারি কাজ তার ব্যবসায়িক পার্টনার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এক সময়ের পাম্প অপারেটর বাদল সরকারের নামে থাকা দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের (বিথী এন্টারপ্রাইজ ও সাইদুল এন্টারপ্রাইজ) নামে অবৈধভাবে এ কাজগুলো করতেন।’ এমপি বাহারের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সব ঠিকাদারি কাজের টেন্ডারের কার্যাদেশ দেওয়ার সময় ৫ শতাংশ (টেন্ডারের মূল্যমানের) সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে ঘুষ হিসেবে প্রদান করতে হতো। ওই ঠিকাদারি কাজের বিল নেওয়ার সময় আরও ৫ শতাংশ টাকা তিনি ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করতেন। কুমিল্লায় এমন প্রবাদও রয়েছে, প্রতি সপ্তাহে তিনি বস্তাভর্তি করে ঘুষের টাকা ঢাকায় নিয়ে যেতেন।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘২০২২ সালের ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায় বিএনপির এক আঞ্চলিক মহাসমাবেশের সময় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বিভিন্ন মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় তার ৭৮টা ফ্ল্যাট রয়েছে। তিনি বিএনপি নেতা-কর্মীদের কুমিল্লা এসে তার ফ্ল্যাটগুলোতে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিএনপির আগত নেতা-কর্মীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করব।’ কথিত আছে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর আরও শতাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে।’ জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু নিজের বিরুদ্ধে থাকা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ট্যাক্স ফাইলের দেখানো সম্পত্তির বাইরে আমার এবং আমার স্ত্রীর আর কোনো সম্পত্তি নেই। শহরে ৭৮ ফ্ল্যাট থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কথার কথা বলেছিলাম। তবে শহরে আমাদের ৪৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এটা আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি। ৬ ভাই ও পাঁচ বোনের জমি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে।