মঙ্গলবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
ন্যায়বিচার চান ২৪২ বিশ্বনেতা

ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন

নিজস্ব প্রতিবেদক

শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে এ চার্জশিটের অনুমোদন দেওয়া হয়। বিকাল সাড়ে ৩টায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানান, গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনা লভ্যাংশের মধ্যে অ্যাডভোকেট ফি হিসেবে প্রকৃতপক্ষে হস্তান্তরিত হয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকা। বাকি ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বোর্ড সদস্যদের সহায়তায় গ্রামীণ টেলিকমের সিবিএ নেতা এবং অ্যাডভোকেটসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মীমাংসা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে আত্মসাৎ করেছেন। একই সঙ্গে অর্থ স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে অবস্থান গোপন করে অর্থ আত্মসাৎ করেন তারা। যা দ বিধি এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অবস্থায় আসামি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে কমিশন থেকে চার্জশিট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও পরিচালক এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দফতর সম্পাদক কামরুল হাসান ও প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম।

দুদক জানায়, গত বছরের ৩০ মে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান মামলাটি করেন। পরে তদন্তে অপরাধের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দফতর সম্পাদক কামরুল হাসানের বিরুদ্ধেও চার্জশিট দেওয়া হয়।

ন্যায়বিচার চান ২৪২ বিশ্বনেতা : সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ১২৫ নোবেল বিজয়ীসহ ২৪২ বিশ্বনেতা আবারও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূস এবং তাঁর তিন সহকর্মীর বিরুদ্ধে দেওয়া ‘অন্যায্য’ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তৃতীয় বারের মতো খোলা চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তাঁরা এই ‘ন্যায়বিচারের সঙ্গে প্রতারণা’ বন্ধের আহ্বান জানান।

এই চিঠিটি গতকাল মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে একটি পূর্ণ-পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে গত বছরের মার্চ ও আগস্ট মাসেও একই ধরনের দুটি চিঠি লিখেছিলেন তাঁরা। প্রতিটি চিঠিতেই আগের বারের তুলনায় বেশি সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছেন। চিঠিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলা হয়, আমরা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর চলমান হয়রানি ও সম্ভাব্য কারাদণ্ডের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতে এই চিঠি লিখেছি। আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক আইরিন খানের সঙ্গে ঐকমত্য জানাচ্ছি। তিনি ১ জানুয়ারি এই রায়কে ‘ন্যায়বিচারের সঙ্গে প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ওই রায়ে প্রফেসর ইউনূসসহ তাঁর অলাভজনক সংস্থা গ্রামীণ টেলিকমের চার বোর্ড সদস্যের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমরা আরও লক্ষ্য করি যে, বাংলাদেশে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিরোধী নেতাদের দমন ও কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও স্বাধীন কণ্ঠস্বরের ওপর ক্র্যাকডাউন প্রত্যক্ষ করেছি আমরা, যা বাংলাদেশ ও বিদেশের অনেক মানবাধিকার ও গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীগুলো ব্যাপকভাবে নথিভুক্ত করেছে। প্রফেসর ইউনূসকে হয়রানি ও ভয় দেখানোর বিষয়ে এর আগের একটি চিঠির জবাবে আপনি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের উচিত বিশেষজ্ঞ এবং আইনজীবী পাঠানো যাতে তাঁরা নথিপত্র ঘেঁটে দেখতে পারেন যে এখানে কোনো অন্যায় হয়েছে কি না। আমরা আপনার এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করছি। এই পরীক্ষায় শুধু শ্রম আইনের মামলাই নয় বরং দুর্নীতি দমন কমিশনের বর্তমান তদন্তও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আমরা এই পর্যালোচনা পরিচালনার জন্য স্বাধীন আইনি বিশেষজ্ঞদের একটি ছোট দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন সিনিয়র আন্তর্জাতিক আইনজীবীকে প্রস্তাব করতে চাই।

আমরা অবিলম্বে এই কাজ শুরু করতে চাই। আমাদের অনুরোধ, প্রফেসর ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের যে কোনো কারাদণ্ড এই পর্যালোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করা হোক।

চিঠিতে আরও লেখা হয়েছে, আপনি জানেন, প্রফেসর ইউনূস ২৪টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬১টি সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ ৩৯টি দেশের ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি ১০টি দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ ৩৩টি দেশ থেকে মোট ১৩৬টি পুরস্কার পেয়েছেন। একই সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার, ইউনাইটেড স্টেটস প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ইউনাইটেড স্টেটস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন ইতিহাসে এমন সাতজনের মধ্যে একজন প্রফেসর ইউনূস। তিনি ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কাছ থেকে ‘অলিম্পিক লরেল অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০২৩ সালে সৌদি আরবে বিশ্ব ফুটবল সামিট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তাঁর কাজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে জীবনযাত্রার উল্লেখযোগ্য উন্নতিতে অবদান রেখেছে। দারিদ্র্য হ্রাস, জলবায়ুু পরিবর্তন, বর্জ্য হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা এবং দরিদ্রদের জন্য শিক্ষার অগ্রগতিতে অবদান রাখার জন্য তাঁর অব্যাহত সক্রিয় নেতৃত্বের অত্যন্ত প্রয়োজন। তাঁকে ভিত্তিহীন অভিযোগে কারাদণ্ড দিলে তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ হবে। এসব কারণে বিশ্ব নেতারা প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে তাঁর নিজ দেশের সরকার কেমন আচরণ করছে তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং তাঁর সহযোগীদের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হওয়া উচিত নয়। আমরা আপনাকে অবিলম্বে ‘ন্যায়বিচারের সঙ্গে এই প্রতারণা’র অবসান ঘটিয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তিসহ মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি সমুন্নত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।

দুদক সচিব বলেন, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলামসহ বোর্ডের সদস্যদের উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত ১০৮তম বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় হিসাব খোলা হয়। গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনা লভ্যাংশ বিতরণের জন্য গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন এবং গ্রামীণ টেলিকমের সঙ্গে মীমাংসা চুক্তি হয় ওই বছরের ২৭ এপ্রিল। গ্রামীণ টেলিকমের বোর্ড সভার হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত ৯ মে হলেও হিসাব খোলা হয় এক দিন আগে ৮ মে। মীমাংসা চুক্তি ও ৮ মে ব্যাংক হিসাব দেখানো আছে, যা বাস্তবে অসম্ভব। এরকম ভুয়া মীমাংসা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ও ১০৮তম বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২২ সালের ১০ মে গ্রামীণ টেলিকমের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ৪৩৭ কোটি ১ লাখ ১২ হাজার ৬২১ টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২২ জুন অনুষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের ১০৯তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অ্যাডভোকেট ফি হিসেবে অতিরিক্ত ১ কোটি ৬৩ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৯ টাকা দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়। অন্যদিকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাব থেকে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন নামীয় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের লোকাল অফিসের হিসাব থেকে তিন দফায় মোট ২৬ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু কর্মচারীদের লভ্যাংশ বিতরণের আগেই তাদের প্রাপ্য অর্থ তাদের না জানিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে ২০২২ সালের মে ও জুন মাসের বিভিন্ন সময়ে সিবিএ নেতা মো. কামরুজ্জামানের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মিরপুর শাখার হিসাবে মোট ৩ কোটি টাকা, সিবিএ নেতা মাইনুল ইসলামের হিসাবে ৩ কোটি ও সিবিএ নেতা ফিরোজ মাহমুদ হাসানের ডাচ-বাংলা ব্যাংক মিরপুর শাখার হিসাবে ৩ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়।

একইভাবে অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলীর কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের ধানমন্ডি শাখার হিসাবে ৪ কোটি টাকা ও দ্য সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাবে ৫ কোটি টাকা এবং অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ ও অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলীর স্ট্যান্ডার্ড টাচার্ড ব্যাংকের গুলশান নর্থ শাখায় যৌথ হিসাবে ৬ কোটি স্থানান্তর করা হয়, যা তাদের প্রাপ্য ছিল না।

সর্বশেষ খবর