বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

জোড়াতালিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

♦ যন্ত্রপাতি নষ্ট ♦ প্যাথলজি টেস্ট হয় বেসরকারি ল্যাবে ♦ সময়মতো আসেন না চিকিৎসক ♦ শূন্যপদে নিয়োগ নেই ♦ অ্যানেসথেসিয়া ডাক্তারের অভাবে হয় না অপারেশন ♦ সরকারি হাসপাতালের দুর্দশায় অবৈধ ক্লিনিকের রমরমা বাণিজ্য

শামীম আহমেদ

জোড়াতালিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

চিকিৎসা প্রয়োজন খোদ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর! সারা দেশের মানুষের চিকিৎসার প্রথম গন্তব্য এ হাসপাতালগুলো চলছে জোড়াতালি দিয়ে। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট। যারা আছেন তারাও সময়মতো অফিস করেন না। অ্যানেসথেসিয়া ডাক্তারের অভাবে হয় না অপারেশন। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার যন্ত্রপাতি। যা আছে তাও অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট। সরকারি হাসপাতালের এমন দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বৈধ-অবৈধ বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। সেখানে গিয়ে মানুষ হচ্ছে সর্বস্বান্ত, কখনো ভুল চিকিৎসায় বড় রকমের ক্ষতির শিকার হচ্ছে রোগী।

গত এক সপ্তাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধিরা দেশের ৩০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শন করে এমন চিত্র পেয়েছেন। অভিযোগ আছে, সরকারি হাসপাতালগুলোর দুরবস্থার পেছনে খোদ স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক চিকিৎসক-কর্মকর্তা জড়িত। দুর্নীতি, চিকিৎসকদের কমিশনবাণিজ্য ও ব্যক্তিগত চেম্বার ব্যবসার কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর সেবার মান বাড়ছে না। সরেজমিন প্রতিবেদনের আলোকে কয়েকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র তুলে ধরা হলো-

মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ২৫ জানুয়ারি দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত দেখা গেছে সুনসান নীরবতা। ছিলেন না বহির্বিভাগের চিকিৎসক, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং আবাসিক মেডিকেল অফিসার। দুপুর দেড়টায় শাম্মী বেগম নামে এক নারী তার শিশু সন্তান নিয়ে হাসপাতালে এসে চিকিৎসক না পেয়ে ফিরে যান। পুরো হাসপাতালে বিপ্লব দেবনাথ নামে একজন অফিস সহায়ককে পাওয়া যায়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসারের পদ রয়েছে ২১টি, বর্তমানে কর্মরত নয়জন, পদ খালি ১২টি। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদ আছে সাতটি, খালি একটি। মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস কে এম শিবলী রহমান জানান, তিনি জরুরি কাজে বাইরে আছেন। আবাসিক মেডিকেল অফিসার পদ শূন্য রয়েছে।

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৬৯ হাজার। বিপুল জনসংখ্যার স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবার একমাত্র অবলম্বন মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক না থাকায় আজ পর্যন্ত অপারেশন হয়নি। আবাসিক চিকিৎসক (আরআমও) ও জরুরি চিকিৎসক (ইএমও) পদ শূন্য। কনসালট্যান্ট ১০টি পদের ৯টি শূন্য। মেডিকেল অফিসার ১৯টি পদের ১০টি শূন্য। তৃতীয় শ্রেণির ১৭৮টি পদের ৬৬টি শূন্য। ছয়জন আউটসোর্সিং স্টাফের (নৈশ প্রহরী, কুক/মশালচী, আয়া, ওয়ার্ডবয়) মধ্যে পাঁচজন গত জুলাই মাস থেকে অনুপস্থিত। সাবমেরিন ক্যাবলের যুগে হাসপাতালটিতে ইন্টারনেটের কাজ চলছে মডেম দিয়ে। অ্যাম্বুলেন্স আছে একটি, চালক নেই ১২ বছর। তিনটি নৌ অ্যাম্বুলেন্সের সবই অকেজো। এর মধ্যে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে দেওয়া ২২ লাখ টাকার নৌ অ্যাম্বুলেন্সটি একজন রোগীর সেবায়ও কাজে লাগেনি। বর্তমানে হাসপাতাল থেকে প্রায় ১ কিমি দূরে খাদ্য গুদামের সামনে খালের চরে পড়ে আছে। জানালা ভাঙা। নেই যন্ত্রপাতি। টেকনিশিয়ান থাকলেও তিন বছর ধরে অকেজো এক্সরে মেশিন। ১০ বছর বন্ধ থাকার পর গত ৬-৭ মাস আগে প্যাথলজি বিভাগ চালু করা হলেও ক্লোরোমিটার ও মাইক্রোস্কোপ না থাকায় তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। ভোলার বোরহানউদ্দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ ৩২টি। কর্মরত আছেন ১১ জন। যশোরের কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক পদ ৩১টি। কর্মরত আছেন ১৯ জন। এর মধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি তিনজনই ছিলেন ছুটিতে। ২৭ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে গিয়ে অনেক চিকিৎসকের কক্ষ (১০১, ২০১, ২০৫, ২০৬, ২০৭, ২০৮, ২১৩, ২১৪) তালাবদ্ধ দেখা গেছে। ছিলেন না আবাসিক মেডিকেল অফিসার। ২০২ নম্বর কক্ষ খোলা থাকলেও ভিতরে কেউ ছিলেন না। ২০৩ নম্বর কক্ষ ছিল ভিতর থেকে বন্ধ। এ ব্যাপারে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘সবাই সময়মতো অফিস করেন। খাতায় স্বাক্ষর করেন।’ তবে কারা ১১টা পর্যন্ত স্বাক্ষর করেছেন দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে রাজি হননি।

পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুরবস্থার সুযোগে উপজেলাজুড়ে গজিয়ে উঠেছে ১০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ পরিচালিত অভিযানে সাতটিরই হালনাগাদ লাইসেন্স পাওয়া যায়নি। এসব নামসর্বস্ব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে প্রতারিত হয়ে সিভিল সার্জন বরাবর অনেকে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। এর মধ্যে ভুল প্যাথলজি রিপোর্টের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ২০২২ সালের জুলাইয়ে অভিযোগ করেন শিউলি আক্তার। গত নির্বাচনের আগে তার মৃত্যু হয়। ভুল প্যাথলজি রিপোর্টের কারণে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে নিউলাইফ ডিজিটাল মেডিকেল সার্ভিসেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন সামসুন নাহার। তবে প্রতিকার পাননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ল্যাবটির মালিক দুমকী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসের তিনজন চিকিৎসকের। গত বছরের জানুয়ারিতে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০২০’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছরই চিকিৎসায় সরকারি ব্যয় কমছে, বিপরীতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৫০ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে রাজধানীসহ শহরের হাসপাতালে চাপ কমত। তবে এজন্য দরকার প্রশিক্ষিত জনবল, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ওষুধ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। তিনটি জায়গাতেই অসম্পূর্ণতা রয়েছে। দেশের মানুষকে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যতজন চিকিৎসক দরকার, আছে তার অর্ধেক। একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স দরকার। আছে দুজন চিকিৎসকের জন্য একজন নার্স। নেই পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বিরাজমান দুর্নীতির একটি হচ্ছে কমিশনবাণিজ্য। যে কারণে সরকারি হাসপাতালে সেবায় ঘাটতি পড়ে। এটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। স্বাস্থ্য খাতে সরকার যত বিনিয়োগ করবে, তার চেয়ে কয়েক গুণ ফেরত পাবে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া কমবে। এ ছাড়া মানুষ অসুস্থ থাকায় জাতীয় অর্থনীতির অনেক শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্য খাতে এক যুগের বেশি সময় ধরে জিডিপির ১ শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন ন্যূনতম ৪-৫ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর