রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের কীভাবে?

জিআই সনদ নিয়ে বিস্ময়

নিজস্ব প্রতিবেদক ও টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের কীভাবে?

বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ঐতিহ্য আড়াই শ বছরের। বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুনাম কুড়িয়েছে তাঁতের এই শাড়ি। বৈচিত্র্যময় নকশার কারণে টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি বাঙালি নারীদের রয়েছে আলাদা টান। কিন্তু বাংলাদেশের ‘টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে’। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ দাবি করছে। এ দাবিতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ফ্যাশন ডিজাইনারসহ বিশেষজ্ঞরা এতে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন করছেন, টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের কীভাবে! এই ঘটনায় ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের তাঁত-সংশ্লিষ্ট মালিক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। তারা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানান।

জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারির দুই তারিখে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। দেশটির জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রির তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প বিভাগ এজন্য ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আবেদন করেছিল।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর, করটিয়া, সন্তোষ, বিন্যাফৈর, বেলতা, বড় বেলতাম, দেলদুয়ার উপজেলার চণ্ডি, পাথরাইল, নলসোঁধা, নলুয়া, দেউজান ও বকুলতলা, কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, কুকরাইল গ্রামের প্রায় সব তাঁতপল্লীগুলোতে তাঁতের শাড়ি তৈরি হয়। আর তাঁতের সঙ্গে মালিক শ্রমিকসহ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জড়িত রয়েছেন। তাঁত-সংশ্লিষ্টরা বলেন, টাঙ্গাইল যেহেতু বাংলাদেশের একটি জেলা এবং ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে সারা বিশ্ব নাম করেছে। এটা কোনোভাবেই ভারতের পণ্য হিসেবে জিআই পেতে পারে না। যদি ভারতের নিজস্ব পণ্য হতো তাহলে কেন টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি নামকরণ হয়েছে, ভারতে টাঙ্গাইল জেলা নামে কোনো জেলা নেই। দ্রুত ভারতের জিআই বাতিল করে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতির দাবি উঠেছে।

টাঙ্গাইল জেলা তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বলতে টাঙ্গাইলকেই বুঝানো হয়েছে। কী কারণে টাঙ্গাইল শাড়ি অন্য জায়গা থেকে জিআই স্বীকৃতি নেবে। এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক। টাঙ্গাইলে উৎপাদন হয় বলেই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি নামে পরিচিত। বিভিন্ন মান এবং দক্ষতার মাধ্যমে এ শাড়িগুলো তৈরি করা হয়। টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ভারত তাদের শাড়ির অন্য নামে দিতে পারে। কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ি নাম দিতে পারে না। আবহাওয়া গত কারণে টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলেই উৎপাদন হয়।

ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজের দাবি করে ভারতের জিআই স্বীকৃতি নেওয়ার বিষয়টি বিশ্বাসই করা যায় না। এ ঘটনায় আমি আশ্চর্য হচ্ছি। যখন থেকে দেশের টাঙ্গাইল এলাকায় এই বিশেষায়িত শাড়িটি উৎপাদিত হয়ে আসছিল, তখন থেকেই একে টাঙ্গাইলের শাড়ি নামেই বলা হতো। আমাদের সবচেয়ে পুরনো কটেজ ইন্ডান্ট্রি হচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁত। টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির কারিগর তথা তাঁতি সবচেয়ে বেশি আছে বাংলাদেশে। দেশভাগের সময় কিছু তাঁতি ভারতের ফুলিয়া ও নদিয়ায় চলে যায়। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিছু তাঁতি ভারতে যান। কিন্তু তাঁতিদের বেশির ভাগই বাংলাদেশে আছেন। আমি নিজেও ফুলিয়ায় কাজ করেছি। বাংলাদেশ থেকে যেটা যায় তা টাঙ্গাইল শাড়ি বলেই পরিচিত। প্রতিবছর ভারতে ৫০ হাজারের বেশি টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে। এসব থেকে ভাবতে অবাক লাগে ভারত কীভাবে টাঙ্গাইল শাড়ির মালিকানা নিজের বলে দাবি করে। সরকার জিআই আইন করে। এ বিষয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। আগে শাড়িটা ৯ থেকে ১০ হাত হলেও এখন তা ১৪ হাত হয়েছে। টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের এত পুরনো একটি ঐতিহ্য তা ভারত কীভাবে নিল তা বোধগম্য নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব নিতে হবে। জামদানি শাড়ি যে বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য, এর সব ইতিহাস যথাযথভাবে ডকুমেন্ট করতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি মনে করেন যে, তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন তা করতে পারেন। আমি মনে করি এখনই আমাদের এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এজন্য যথাযথ কাগজপত্র ঠিক করতে হবে। যাতে আমরা এটি আটকাতে পারি।

ফ্যাশন এন্টারপেনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজহারুল হক আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি আমাদের জন্য বিস্ময়কর হলেও ভারত এ কাজ এর আগেও করেছে। জামদানির ক্ষেত্রেও তারা এমনটি করেছে। সমস্যা হচ্ছে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ থেকে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই শাড়ির জিআই করার জন্য আমরা চার-পাঁচ বছর আগে থেকে কাজ শুরু করেছি। এই কাজ বস্ত্র মন্ত্রণালয় ও তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে হচ্ছিল। কিন্তু গত তিন-চার বছরে সরকারিভাবে এই কাজের গতি কমে যায়। আমরা গত সপ্তাহেও এ বিষয়ে একটি বৈঠক করেছিলাম। এর মধ্যে ভারতের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতির কাজ এগিয়ে যায়। আমরা দুই-একদিনের মধ্যেই একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করব। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়গুলোতে দুটি কাজ করার জন্য চিঠি দিচ্ছি। জিআই-এর ক্ষেত্রে ভৌগোলিক নির্দেশনা বা জায়গাটি মূল বিষয়। টাঙ্গাইল তাঁত বলতে আসলে টাঙ্গাইল জায়গাটিকে বোঝায়। ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য যেভাবে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে সেভাবে আসলে হয় না। আমরা বাংলাদেশের ফ্যাশন উদ্যোক্তারা এখন এ বিষয়ে আইনি বিষয়গুলো খোঁজার চেষ্টা করছি। আর এগুলো দিয়ে আমরা ইউনেস্কোতে প্রতিবাদ করব। আর দ্বিতীয়ত টাঙ্গাইলের জিআই স্বীকৃতি পেতে যে আবেদন তা আমাদের দ্রুত করতে হবে। জামদানির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। ভৌগোলিক নির্দেশনায় জামদানি ও টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদেরই প্রাপ্য। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা যে এ জন্য আগে আবেদন করতে পারিনি, তা আমাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিতে হয়।

কবি মাহমুদ কামাল বলেন, কয়েক শ বছরের পুরনো টাঙ্গাইলের শাড়ি। এটি কীভাবে অন্য দেশের নামে জিআই পণ্য হয়। এটি অদ্ভুত বিষয়। ভারত থেকে অনেক কবি সাহিত্যিক বাংলাদেশে বেড়াতে এলে তাদের প্রথম পছন্দ থাকে টাঙ্গাইলের শাড়ি। এখান থেকে বাহারি ডিজাইয়ের শাড়ি নিয়ে তারা পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যান। সেই টাঙ্গাইলের শাড়ি কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ জিআই স¦ত্ব পায়। দ্রুতই টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই স্বত্ব টাঙ্গাইলের নামে পেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি আড়াই শ বছরের ঐতিহ্য। তাঁতের শাড়িসহ তিনটি পণ্য জিআই হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি। আমরা আশাবাদী জিআই স্বীকৃতি পাব। ভারত জিআই আবেদন করলে টাঙ্গাইল শাড়ির ব্র্যান্ডিং করা হয়। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এই তাঁত শাড়ি জিআই পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়। টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িকে ভারতের শাড়ি হিসেবে দাবি করার প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবের সামনে সচেতন নাগরিক সমাজের উদ্যোগে এ মানববন্ধের আয়োজন করা হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের অহংকার। টাঙ্গাইলের শাড়ির স্বীকৃতি ভারত কখনোই পেতে পারে না। ভারতের এ দাবি অযৌক্তিক। এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আমরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, দ্রুতই টাঙ্গাইলের শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য।

সর্বশেষ খবর