সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

তুমুল যুদ্ধ মিয়ানমার সীমান্তে

পাঁচ বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ, পালিয়ে এসেছেন মিয়ানমারের ৬৮ সীমান্তরক্ষী

নিজস্ব প্রতিবেদক

তুমুল যুদ্ধ মিয়ানমার সীমান্তে

যুদ্ধের তীব্রতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি-সংলগ্ন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। সীমান্ত জনপদ পরিণত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। ওপার থেকে নিক্ষিপ্ত গুলিতে বাংলাদেশের পাঁচজন আহত হয়েছেন। পুড়েছে অনেক বসতঘর। আতঙ্কে বাড়িছাড়া অনেক মানুষ। বিদ্রোহী গ্রুপের ব্যাপক গোলাগুলির সামনে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপির ৬৮ জনের মতো সদস্য কয়েক দফায় বাংলাদেশের ভূখন্ডে ঢুকে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তে   শুরু হওয়া গোলাগুলি ও বোমা বর্ষণ গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আহত ১৫ বিজিপি সদস্যকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে বিজিবি।

এদিকে সীমান্ত পথে আরও ৫০ জনেরও বেশি বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে ঢোকার জন্য অবস্থান নিয়েছেন বলে সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে কাউকে আসতে দেব না। বিজিবিকে সেই নির্দেশনা দিয়েছি। মিয়ানমারের পুলিশ আত্মরক্ষার্থে বাংলাদেশে ঢুকেছে। আমরা তাদের আটক রেখেছি, ফেরত পাঠাব। তিনি বলেন, মিয়ানমারে বিদ্রোহ লেগেই আছে। রাখাইনের অনেক এলাকা একের পর এক দখল করে নিচ্ছে আরাকান আর্মি নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী। মিয়ানমারের বিজিপির ঘাঁটিগুলোও দখল করে নিচ্ছে আরাকান আর্মি। আত্মরক্ষার্থে বিজিপির কয়েকজন সদস্য আমাদের সীমানায় ঢুকে বিজিবির কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। বিজিবি সদস্যরা তাদের অস্ত্র জমা নিয়ে একটি জায়গায় আটকে রেখেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে, যাতে তারা এদের নিয়ে যান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই আমাদের সেই নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তার মানে এই নয় যে, আমাদের গায়ে এসে পড়বে আর আমরা ছেড়ে দেব। সেটার জন্য আমরা সব সময় তৈরি আছি। আমরা সীমান্তে শক্তি বাড়িয়েছি। আমাদের পুলিশ ও কোস্টগার্ডকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে আমাদের সীমানায় কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যদি মনে করে, তাদের ওখানে যুদ্ধ হচ্ছে, তারা অন্য কোথাও যাবে, এ মুহূর্তে আর কাউকে আমরা ঢুকতে দেব না। সীমান্তে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ আল মাশরুকী বলেন, রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ ঘিরে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একজন রোহিঙ্গাকেও আর প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। গত মাসের শেষ দিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরের এ যুদ্ধ বেগবান হওয়ার পর থেকে প্রায়ই গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে। গতকালও ওপার থেকে বেশ কয়েকটি গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে বাংলাদেশ ভূখন্ডের তুমব্রু কোনার পাড়া, মাঝের পাড়া ও বাজার পাড়ায়। আতঙ্কে ঘর ছেড়েছে এই তিন গ্রামের মানুষ। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন পাঁচজন। কোনার পাড়ার কয়েকটি বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে আহতরা হলেন- কোনার পাড়ার বাসিন্দা প্রবীন্দ্র ধর (৫০), রহিমা বেগম (৪০), টিটু (৩০) এবং আমির হোসেনের ছেলে শামসুল আলম, অন্যজনের পরিচয় জানা যায়নি। তাদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সীমান্তবর্তী পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা। সব মিলে চরম আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা। স্থানীয় ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ জানান, তিন গ্রামের হাজারো মানুষ পরশু রাত থেকে বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। গরু, ছাগল, হাস, মুরগি ওই অবস্থায় রেখে ঘরবাড়ি ছেড়েছে সবাই। মালামাল নেওয়ারও সুযোগ হয়নি।
আমাদের কক্সবাজার ও বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, শনিবার রাত ৩টা থেকে ব্যাপক গুলি বর্ষণের পাশাপাশি মর্টার শেল নিক্ষেপ চলছে সীমান্তের ওপারে। জান্তা বাহিনী যুদ্ধ হেলিকপ্টার থেকে বোমা ছুড়ছে বিদ্রোহীদের অবস্থান লক্ষ্য করে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর সামরিক হেলিকপ্টারকে সীমান্তের ওপারে চক্র দিতে দেখা যায়। হেলিকপ্টার থেকে বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে গুলি, মর্টার শেল ও বোমা বর্ষণ করা হয়। পাল্টা জবাবে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যরা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। গতকাল সন্ধ্যার দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। এতে সীমান্তের বাজারঘাট বন্ধ রয়েছে। মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট ক্যাম্পের চারপাশ ঘিরে রেখেছে আরাকান আর্মি। বর্ডার অবজারভেশন পোস্টও দখলে নিয়েছে বিদ্রোহী গ্রুপটি। উপর্যুপরি হামলায় ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে পড়েছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ডের সদস্যরা। তাদের অনেকেই আহত। ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, মিয়ানমারের বিজিপির কিছু সদস্য তুমব্রু সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সীমান্ত লাগোয়া স্কুলগুলো আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিজিবিও নিরাপত্তা বাড়িয়েছে সীমান্তে। নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে টহল জোরদার করা হয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, সীমান্তে যাতে অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সীমান্তের দিকে নজর রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারে সংঘাতের জেরে বাংলাদেশ সীমান্তে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেছেন, সীমান্তে আমরাও বিজিবির সঙ্গে কাজ করছি। বিজিবি আমাদের কাছে যে সহযোগিতা চাইবে, আমরা তাদের সেটা দেব।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। এ সংঘর্ষের জের ধরে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তেও উত্তেজনা চলছে। মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে মিয়ানমারের তুমব্রু ক্যাম্পটি। সীমান্তজুড়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। আতঙ্কে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হেলিকপ্টার ও সামরিক বিমান থেকে গোলা ও বোমা বর্ষণ চলছিল।

সর্বশেষ খবর