মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

দুর্নীতি দ্রব্যমূল্য চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে জোর

♦ সচিবদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তিন ঘণ্টা বৈঠক ♦ ইশতেহার বাস্তবায়ন করের আওতা বাড়ানোসহ নানা নির্দেশনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি দ্রব্যমূল্য চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে জোর

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দেওয়া ইশতেহারকে ভিত্তি ধরে আগামী পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনা সাজাতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমনে ব্যবস্থা নেওয়া, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা সচিবদের একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের পর গতকাল তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেন সরকারপ্রধান। এতে মোট ১৬ জন সচিব বক্তব্য দেন। তিন ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সচিবদের বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকেই প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। বিকালে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সচিব এবং জনপ্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা সমুন্নত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যে কথাটি সচিবদের জন্য সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে বলেছেন তা হচ্ছে, দায়িত্ব পালনে আত্মপ্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান বজায় রেখে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে।

পরিকল্পনা সাজানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি অঙ্গীকারকে গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে একটা ধারাবাহিকতা আছে। ২০৪১ সাল নাগাদ ‘স্মার্ট’ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ করতে চাচ্ছেন, তার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে এ ইশতেহারে। যেহেতু জনগণ রায় দিয়েছে। তাই এ নির্বাচনি ইশতেহারটা হবে আগামী পাঁচ বছরের সরকার পরিচালনার মূলনীতি। এ দলিল বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এর বাস্তবায়নে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সমন্বয়ের কাজ করবে। কোন মন্ত্রণালয়ের কী কাজ, তা চিহ্নিত করা হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ ভাগ করা হবে। কাজগুলো ঠিকমতো তদারকি করতে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিসহ প্রশাসনের যে কটি পন্থা আছে তার সবের মধ্যে সমন্বয় করতে বলা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। বৈঠকের শুরুতে সচিবদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দিকনির্দেশনার পাশাপাশি গত সভার নির্দেশনাগুলো নিয়েও পর্যালোচনা হয় এ সভায়। এর বাইরেও আরও বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন উল্লেখ করে মাহবুব হোসেন বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আসন্ন রোজার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। কৃষি উৎপাদন ও সার ব্যবস্থাপনা, কর্মমুখী শিক্ষা, নতুন পাঠক্রম ও কর্মসংস্থান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও জ্বালানি নিরাপত্তা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্প ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও আর্থিক খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, সচিব সভায় সংসদ কার্যক্রমে বিশেষ করে প্রশ্নোত্তর পর্ব নিয়েও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি চান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যেন আরও সহযোগিতা করে, সম্পূরক প্রশ্নের উত্তর যেন যথাযথভাবে সরবরাহ করা হয়। যেদিন যে মন্ত্রণালয়ের প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকবে, সেদিন যেন সেই মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। কর্মকর্তাদের সংসদ কার্যবিধি সম্পর্কে প্রশিক্ষিত হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতি দমনে ব্যবস্থা নিতে সচিবদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) না। দুর্নীতি নিরসন ও প্রতিরোধের দায়িত্ব প্রতিটি মন্ত্রণালয়েরও। তাই যেখানে যেখানে ‘সার্ভিস পয়েন্ট’ আছে, সেখানে নজরদারি বা ভিন্নতর কৌশল অবলম্বন করে যে প্রক্রিয়া নেওয়া দরকার, তা নিয়ে দুর্নীতি দমনে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ‘শক্ত ব্যবস্থা’ নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, নজরদারির ক্ষেত্রে উনি একটা সুনির্দিষ্ট এরিয়ার কথা বলেছেন যে, অনেক সময় আমাদের দ্রব্যমূল্যের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির প্রসঙ্গ আসে, নিউজ আসে। এটির ক্ষেত্রে উনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুবই শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন যেন এটি কোথাও না হয়। আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ছিনতাই, কিশোর গ্যাং বা এ রকম যেসব অপরাধ হচ্ছে সে ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করে নজর দিতে বলেছেন। তিনি জানান, নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, তাঁর মূল লক্ষ্য জনমানুষের অবস্থানের উন্নয়ন। কাজেই প্রকল্প থেকে জনমানুষের উন্নয়ন হয়েছে কি না তা তিনি জানতে চাইবেন। সুতরাং নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সে বিষয়টি দেখতে বলেছেন। চলমান যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলো তিনি দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মুদ্রাস্ফীতির কথা বলেছেন। মুদ্রাস্ফীতি আমাদের জিডিপি গ্রোথের নিচে থাকতে হবে। সেটি করার জন্য উনি কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আয়করের আওতা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এখনো বিরাটসংখ্যক ব্যক্তি যাদের আয়কর দেওয়ার কথা তারা আয়করের আওতায় আসেনি। তাদের যেন আয়করের আওতায় আনা হয় সেজন্য জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। অহেতুক যেন তারা হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে নজর রাখতে বলেছেন। বিনিয়োগ আসতে কোনো জটিলতা হলে তার নজরে যেন নেওয়া হয়। কোনো কারণে যদি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়, উনি ভালোভাবে নেবেন না। সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি সুবিধার বিষয়ে নিয়ে বলেছেন। আমরা গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে যে সুযোগসুবিধা পাই কৃষিজাত পণ্য, চামড়া এবং পাটজাত পণ্যে একই রকম সুযোগসুবিধা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন এবং কাজ করতে বলেছেন। গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে একটা বড় অংশ আমদানি করতে হয়। একটা বড় অংশ চলে যায় আমদানির ক্ষেত্রে। এ তিন পণ্যে আমাদের স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল আছে। সুতরাং এখানে ভ্যালু অ্যাড অনেক বেশি হবে। রপ্তানি বাজারের ক্ষেত্রে নতুন বাজার খুঁজতে বলেছেন। মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় যেন বাজার খুঁজি, বিশেষ করে ওষুধ, পোশাক, খাদ্য, কৃষিজাত পণ্য, পাটজাত পণ্যের। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রয়োজন হলে যেন সহায়তা দেওয়া হয়। খাদ্য উৎপাদনে নজর দিতে বলেছেন।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্দেশনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য বলেছেন। বিশেষ করে সেচ মৌসুমে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে বলেছেন। কোনোভাবে যেন সেচ মৌসুম বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন। সেচের ক্ষেত্রে সোলার এনার্জি ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন। ব্লু-ইকোনমির জন্য সামুদ্রিক যে ব্লক আছে সেখানে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বলেছেন। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছেন। এখন যে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলোর যেন সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়, কোয়ালিটি প্রশিক্ষণ হয়। সার্ভিস সেক্টরে প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ নজর দিতে বলেছেন। বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বেই প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। সেজন্য উনি বিশেষ উদ্যোগ নিতে বলেছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ইতোমধ্যে উনি (প্রধানমন্ত্রী) যে উন্নয়ন করেছেন তার যেন ধারাবাহিকতা থাকে। এটির দিকে খেয়াল রেখে নতুন প্রকল্প বা কার্যক্রম নিতে বলেছেন। ইতোমধ্যে যেগুলো করেছেন সেগুলো যেন হারিয়ে না যায়। শূন্যপদ পূরণের জন্য উদ্যোগ নিতে বলেছেন এবং সময়মতো পদোন্নতির জন্য বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা আছেন, প্রয়োজনে তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিশেষ উদ্যোগ নিতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী খাদ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত রাখার জন্য বলেছেন। এখন যে ক্যাপাসিটি আছে তা বৃদ্ধির জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। খাদ্য সংরক্ষণ ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের ক্ষেত্রেও সুবিধা দেওয়ার জন্য বলেছেন। তিন ফসলি জমি যেন কোনো অবস্থায়ই নষ্ট না হয়। সেখানে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা যাবে না। জলাধার ভরাট করা যাবে না। জলাধার অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই নদীর ধারাবাহিকতা বা প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। সেচের ক্ষেত্রে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে। সচিব সভায় নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ভুলভ্রান্তি থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, নতুন যে শিক্ষাক্রম নেওয়া হয়েছে তা প্রচলিত শিক্ষাক্রম নয়। তা থেকে ভিন্ন একটা। এ বাস্তবতা আমাদের মানতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যদি কোনো ভুলভ্রান্তি, যদি কোনো তথ্যগত বা কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় তাহলে দ্রুত যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোনো বিলম্ব হবে না। কোনো গ্যাপ তৈরি হলে যেন যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে বলেছেন।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, গত সংসদে যে আইন পাস হয়নি সেগুলো দ্রুত মন্ত্রিসভায় এনে যেন সংসদে পাঠানো হয়। সামরিক আমলে ১৬৬টি আইনের বিকল্প আইন করার জন্য উচ্চ আদালত থেকে বলা হয়েছিল, সেখানে ১৬টি আইন বাকি আছে। এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিয়ে যেন কাজ করা হয় সে নির্দেশনা দিয়েছেন।

সভায় সীমান্তের বিষয়ে আলোচনা নিয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সেটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। সভায় উপস্থিত এক সচিব নাম প্রকাশ না করে বলেন, সীমান্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সতর্ক থেকে কাজ করতে বলেছেন। যারা ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে তাদের চিকিৎসা দিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখবে, সে বিষয়ে বলেছেন।

সর্বশেষ খবর