মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ধর্ষণের ঘটনায় থমথমে জাবি

ধরাছোঁয়ার বাইরে বহিরাগত মামুন, মাদক ব্যবসার সম্পর্ক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে, ঢাকায়ও বিক্ষোভ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও জাবি প্রতিনিধি

ধর্ষণের ঘটনায় থমথমে জাবি

আবাসিক হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসে এখন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পরীক্ষার হল থেকে শুরু করে ক্লাসরুম, আবাসিক হল, শিক্ষক অফিস, ক্যান্টিন, চায়ের দোকান সর্বত্র একই আলোচনা। ঘটনার বিচার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তিনটি দাবিই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেওয়ার পর গতকাল আবারও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তারা। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ‘নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চ’। আজও ক্যাম্পাসে    বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করবে তারা।

এদিকে, বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখা সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা বহিরাগত যুগলের সঙ্গে অহরহই ঘটে নিপীড়নের ঘটনা। বহিরাগতদের সঙ্গে ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ক্যাম্পাসে নিয়মিত ঘটলেও কেউ অভিযোগ দিতে সাহস পায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শক্ত ভূমিকার অভাব ও নিপীড়িতদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ না করায় পার পেয়ে যায় ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় থাকা অপরাধীরা। তবে এই প্রথম কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ করায় প্রকাশ্যে এসেছে ভিতরের পরিস্থিতি। জাবির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। যখনই এ ধরনের অভিযোগ আমরা পাই নিরাপত্তা শাখার পক্ষ থেকে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতার অভাব ও ছাত্র রাজনীতির মারপ্যাঁচে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে, তাতে এসব ঘটনার কোনো সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয় না।

ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে মামুনের মাদক ব্যবসার সম্পর্ক : জাবির আবাসিক হলে স্বামীকে বেঁধে রেখে বহিরাগত নারী ধর্ষণের ঘটনায় এখনো পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে বহিরাগত মামুনুর রশীদ মামুন (৪৫)। মামুন এই ধর্ষণকাণ্ডের মূল হোতা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামুনের বাড়ি নওগাঁ জেলার পত্নীতলা। তার বাবার নাম হাসির উদ্দিন। শাখা ছাত্রলীগের অভিযুক্ত নেতাদের সঙ্গে মাদক ব্যবসার সম্পর্ক মামুনের। মামুন নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে মাদক সেবন করতেন এবং হলের ছাত্রলীগ নেতাদের মাদকের জোগান দিতেন।

নিপীড়নের শিকার নারী ও তার স্বামী জাহিদ মিয়া ওরফে রবিনের (২৪) সঙ্গে মামুনের পরিচয় পাঁচ মাস আগে। গাজীপুরের কাশিমপুর থানার ভবানীপুরের বটতলার যে বাসায় ভুক্তভোগী দম্পতি ভাড়া থাকত, সেই বাসার একই কক্ষে ধর্ষণ ঘটনার আগে ১২ দিন তারা তিনজন একসঙ্গে থেকেছেন।

জাহিদের কাছে মামুন সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, মামুনের নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। সে একেক সময় একেক পেশা বেছে নিত। মামুন সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য আমার কাছে আছে। মামুন গ্রেফতার হলে তারপর সেগুলো প্রকাশ করব। এদিকে জাহিদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহিদেরও নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। তিনি এক বছর ধরে বেকার এবং মামুনের কাছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পান। তবে প্রতিবেশীরা জানান, পেশার কথা জিজ্ঞেস করলে জাহিদ একেক সময় একেক পেশার কথা বলে। যে ব্যক্তির মাধ্যমে জাহিদ বাসা ভাড়া নিয়েছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জাহিদ তাকে বলেছে, সে কাশিমপুরের হাতিমারা এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে একটি ডেকোরেশনের দোকানে কাজ করে। আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, পলাতক দুজনের খোঁজে আমাদের টিম কাজ করছে। খোঁজ পাওয়া মাত্রই আপনাদের জানানো হবে। এদিকে, মীর মশাররফ হোসেন হলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষটির দখল ছিল মোস্তাফিজুরের হাতে। কক্ষটিতে কেউ থাকত না। মাদক সেবন, চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণ আদায়ে ধর্ষণে অভিযুক্তরা কক্ষটি ব্যবহার করত। মামলার এজাহারে নিপীড়নের শিকার নারীর স্বামী জাহিদের বয়ান অনুযায়ী, ঘটনার দিন শনিবার রাতে মুঠোফোনে মামুন তাকে জানান, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে তার পরিচিত মোস্তাফিজুর রহমানের (শাখা ছাত্রলীগের সদ্য বহিষ্কৃত আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক) সঙ্গে কিছুদিন থাকবেন। মামুন ক্যাম্পাসে এসে জাহিদকে দেখা করতে বলেন। জাহিদ ক্যাম্পাসে এসে ৩১৭ নম্বর কক্ষে যান।

একপর্যায়ে মামুন জাহিদকে জানান, সাভারের একটি ইলেকট্রনিকসের দোকানে তারা কিছু টাকা পাবেন, তবে দোকানদার টাকা দিতে চাচ্ছেন না। ওই টাকার বিনিময়ে দোকানটি থেকে জাহিদকে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটরসহ অন্যান্য আসবাবপত্র কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এ ছাড়া, মামুন কিছুদিন ক্যাম্পাসে থাকবেন বলে তার ব্যবহার্য কাপড়গুলো জাহিদের বাসা থেকে নিয়ে আসা দরকার বলে জানান। মামুন বলেন, জাহিদের স্ত্রী যেন কাপড়গুলো নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন। স্বামীর নির্দেশ পেয়ে ভুক্তভোগী নারী রাত ৯টার দিকে ক্যাম্পাসে আসেন। একপর্যায়ে অভিযুক্ত মুরাদ জাহিদকে ৩১৭ নম্বর কক্ষে বেঁধে ফেলেন ও মারধর করেন। পরে মোস্তাফিজ ও মামুন ওই নারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলসংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করেন।

জাবিতে ধর্ষণের ঘটনায় সুজনের উদ্বেগ : দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন। গতকাল এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, জরুরি ভিত্তিতে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় বাদীপক্ষ বিচার পাবেন না এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। আমরা একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণসহ দেশের সর্বত্র নারী ও শিশুসহ সব নাগরিকের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছি।

বুয়েটে মানববন্ধন : জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ধর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও জড়িতদের অবিলম্বে শাস্তির আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন। গতকাল দুপুর ১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে তারা মানববন্ধন করেন। বুয়েট শিক্ষার্থীরা অতীতের এমসি কলেজ ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে এটিকে মৌলিক মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে মনে করছেন। ভবিষ্যতে এরকম ন্যক্কারজনক অপরাধ যাতে কেউ না করে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ও নারীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি তোলেন তারা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ : জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচারের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। গতকাল ক্যাম্পাসের ভিতরে তারা এই বিক্ষোভ মিছিল করেন। বিক্ষোভ শেষে নাগরিক ছাত্রঐক্যের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মেহেদী হাসান, রাবি শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি রায়হান আলী, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শাকিল হেসেন, রাবি ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার আলিফ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর