শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
তদন্ত শুরু করেছে ইউজিসি

অনিয়মের শেষ নেই উপাচার্যদের

♦ অনিয়মে জড়ালে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে- ইউজিসি চেয়ারম্যান ♦ অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেবে সরকার- শিক্ষামন্ত্রী

আকতারুজ্জামান

অনিয়মের শেষ নেই উপাচার্যদের

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিয়েছেন ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ড. আবদুর রশীদ। এই নিয়োগের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। অথচ যাকে নিয়োগ দিয়েছেন সেই কামরুল ইসলামকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক। এ ছাড়াও বাসার কাজের মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া, সরকারি বিধি অমান্য করে গাড়ি মেরামত ছাড়াও উপাচার্য ড. আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে ১০ দফা অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে ইউজিসি।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের অন্ত নেই। নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়াও অনেক অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। আরও কয়েক উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিগগিরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষার শৃঙ্খলা ধরে রাখতে অধিকতর যাচাই-বাছাই করে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। অন্যদিকে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলছেন, উপাচার্যরা যদি অনিয়মে জড়িয়ে যান তবে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তাছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা কঠিন। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শেখ আবদুস সালামের বিরুদ্ধেও অনিয়ম-অভিযোগের শেষ নেই। গত বছর এই উপাচার্যের কণ্ঠসদৃশ অন্তত ১৫টি ফোনালাপ কথোপকথনের রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই কথোপকথনে উঠে আসে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের আগে টাকার বিনিময়ে প্রশ্নফাঁস করে দেওয়া, নিয়োগের আগে চেক ও সিন্ডিকেটের দিনে অর্থ গ্রহণ, তদবিরের মাধ্যমে ফাইন আর্টস বিভাগে নিয়োগ দেওয়াসহ অসংখ্য বিষয়। উপাচার্য শেখ আবদুস সালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স¦জনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে তা তদন্ত করতে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন শাপলা ফোরাম ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে ইউজিসি। অভিযোগ রয়েছে- অ্যাক্ট ও স্ট্যাটিউট লঙ্ঘন করে নিজের ইচ্ছেমতো নিয়োগ বোর্ড গঠন করেছেন এই উপাচার্য। এই উপাচার্য চিকিৎসা ভাতা খাত চালু করেছেন, যা অতীতে কোনো উপাচার্য করেননি।

বিজ্ঞাপিত পদের থেকে বেশি নিয়োগ দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ধারা লঙ্ঘন করে নিয়োগ, পদ না থাকলেও কর্মকর্তা নিয়োগ ছাড়াও অনেক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির লিখিত অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে এই উপাচার্য বাধাহীনভাবে অনিয়ম করছেন, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি তলানিতে এসে ঠেকেছে। শিক্ষক সমিতির এমন লিখিত অভিযোগ পেয়ে তা আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। শিক্ষক সমিতির অভিযোগে বলা হয়, নিয়োগে অনিয়মের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ার শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। কয়েক চাকরিপ্রার্থী আবেদন না করেও এখানে চাকরি পেয়েছেন। এসব অনিয়মের বিষয়ে শিক্ষক সমিতি বারবার উপাচার্যকে অবগত করা হলেও তা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। উপাচার্য শিরীন আখতারের বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে মাঝেমধ্যে উত্তাল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি এর মাত্রা আরও বেড়েছে। এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এই উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বর্তমানে আন্দোলনে সরব রয়েছে। একই দাবিতে সংবাদ প্রদর্শনী, অবস্থান কর্মসূচি, কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছে শিক্ষক সমিতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির এক কর্মকর্তা জানান, এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে নিয়োগে আত্মীয়প্রীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। উপাচার্য হয়ে কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দিয়েছেন তার ছোট ছেলেকে। আর উপ-উপাচার্য থাকাকালীন নিয়োগ দেন বড় ছেলেকে। এর আগে তার ভাগনিকেও নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির এক কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, উপাচার্য ড. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়ার অনিয়ম খতিয়ে দেখতে শিগগিরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।

উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, স্বজনপ্রীতি আর বিভিন্ন মহলের চাপ এড়াতে পারেন না অনেক উপাচার্য, আর এভাবেই অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন তারা। অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতি বৃহৎ আকারে দেখলে সেটি দুর্নীতি। আমি মনে করি, উপাচার্য নিয়োগে আরও স্বচ্ছতা ও কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। উপাচার্যরা যদি অনিয়মে জড়িয়ে যান তবে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, তাছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা কঠিন। ধর্ষণ নিয়ে উত্তাল হওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের বিরুদ্ধে রয়েছে যৌন নিপীড়নের বিচার না করার অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের একাধিক অভিযোগ থাকলেও দেড় বছর ধরে উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম বিচারের বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছেন। যদিও অভিযুক্ত মাহমুদুর রহমান জনির চাকরিচ্যুতির দাবি রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। তথ্যমতে, এ বিষয়ে হওয়া তদন্ত কমিটির কাছে জনি নিজেই তার অপরাধ স্বীকার করেছেন। উপাচার্য চাইলে বিচার শেষ করতে পারেন। কিন্তু এর অগ্রগতি করেননি উপাচার্য। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. হাসিবুর রশীদ লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মণ্ডলকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অনিয়মের মাধ্যমে সহযোগী অধ্যাপক এর শূন্য পদে নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপক উপাচার্যের অনিয়মের অভিযোগ তুলে ইউজিসিতে লিখিত অভিযোগ দিলে ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর জবাব দিতে সাত দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সম্প্রতি প্রতিবেদককে বলেন, প্রধানমন্ত্রী এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে সুশাসনের ওপর জোর দিয়েছেন। তাই কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার।

সর্বশেষ খবর