শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পাঁচ সমস্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

♦ জনবল সংকটে দুর্ভোগ ♦ হলে ছাত্রলীগের আগ্রাসন ♦ ক্যাম্পাসে মাদকের থাবা

রায়হান ইসলাম, রাবি

বিভিন্ন সেক্টরে জনবল সংকট, ক্যাম্পাসজুড়ে মাদক সেবন, আবাসিক হলে ছাত্রলীগের দখলদারি, চুরি-ছিনতাইয়ের প্রকোপ এবং নিরাপদ খাবার ও পানি সমস্যায় জর্জরিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এসব সমস্যা সমাধানে প্রশাসন কিছু উদ্যোগ নিলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে ভোগান্তি।

কয়েক বছর থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে বিভিন্ন দফতর ও আবাসিক হল এবং বিভাগে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সংকট প্রকট হয়েছে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না, অন্যদিকে দাফতরিক বিভিন্ন কাজে ভোগান্তি বাড়ছে। সংকট তৈরি হয় চিকিৎসা কেন্দ্রে। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়েও পিছিয়ে পড়ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ এ বিদ্যাপীঠ। জানা গেছে, ২০২০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা ২০২৩ সালের জুলাইয়ে উঠে যায়। তবে তথ্য গোপনের অভিযোগ এনে উচ্চ আদালতের করা রিটে একই বছরের অক্টোবরে ফের নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দফতরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৪৯০ সৃজিত শিক্ষক পদের বিপরীতে শূন্য ৪৩৫টি, ৭৯২ কর্মকর্তা পদের বিপরীতে শূন্য ২০০টি, ১ হাজার ৪২ সহায়ক কর্মচারী পদের বিপরীতে শূন্য ২৫১টি এবং ১ হাজার ৯০৯ সাধারণ কর্মচারী পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ৯০৯টি। জানা গেছে, অন্যান্য বিভাগ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, মাইক্রোবায়োলজি, আইন ও ভূমি প্রশাসন এবং চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভোগান্তি চরমে। পাঁচ বিভাগে প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ২৪ জন। ফলে একজন শিক্ষক পড়ান ৫-৭টি কোর্স। এতে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার অভিযোগ শিক্ষকদের।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পাঁচজন শিক্ষক ৪৮টি কোর্স পড়ান। ক্লাসের চাপে গবেষণার সুযোগ পাচ্ছেন না শিক্ষকরা। পর্যাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারী নেই। শিক্ষকদেরই কেরানির কাজ করতে হয়। এভাবেই চলছে। শিক্ষার্থী শুধু সার্টিফিকেট পাচ্ছেন, কিন্তু জাতি বঞ্চিত হচ্ছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে চলতে পারে না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিচালক ডা. তবিবুর রহমান শেখ বলছেন, চিকিৎসক সংকটে যথাযথ চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের অধ্যাপক সালেহ আহমেদ নকীব বলেন, ‘শিক্ষার মান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ও কাক্সিক্ষত গবেষণার অভাবে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়।’

আবাসন সংকট : বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাত দশকে কাটেনি আবাসন সংকট। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে ১৭টি হল। এতে মাত্র ১০ হাজার জন আবাসন সুবিধা পেলেও ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী এ সুবিধা বঞ্চিত। আবাসিক সুবিধা পেলেও কাটেনি সিটকেন্দ্রিক জটিলতা। ছয়টি হলের গণরুমে ছাত্রীদের একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। পর্যাপ্ত আলোবাতাসের অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি পড়াশোনা ও মানসিক চাপের অভিযোগ রয়েছে। আবাসন সংকট নিরসনে ছাত্রীদের জন্য শেখ হাসিনা হল ও ছাত্রদের জন্য শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান হলের নির্মাণকাজ চলছে। এ প্রকল্পের কাজ ২০১৭-২২ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নানা জটিলতায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় এ বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এখনো শেখ হাসিনা হলের অর্ধ শতাংশ ও শহীদ কামারুজ্জামান হলের ২০ শতাংশ কাজ বাকি। সম্প্রতি শহীদ কামারুজ্জামান হলের ছাদধসের পর অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। ঢিমেতালে চলছে প্রকল্পের অন্য কাজগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক খন্দকার শাহরিয়ার বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা নিয়ে আমরা সন্দিহান।’

হলে ছাত্রলীগের আগ্রাসন : বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই সিট দখল, মারধর ও হুমকিধমকির অভিযোগ ওঠে। গত এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অর্ধশতাধিক অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পর এ সমস্যা আরও বেড়েছে। গত তিন মাসে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হলের কক্ষগুলোয় নিয়মিত অভিযান, শিক্ষার্থীদের সিট ছাড়তে চাপপ্রয়োগ ও হুমকিধমকি দিয়ে সিট দখলের ডজনখানেক অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, তবে অভিযোগ উঠলেও হল প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এমনকি বিভিন্ন সময় নিজের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেছেন একাধিক প্রাধ্যক্ষ।

হলে ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডকে ‘আগ্রাসন’ আখ্যা দিয়ে বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শাকিল হোসেন বলেন, ‘বহু বছর ধরে হলগুলোয় সিট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় না। এ সুযোগে ছাত্রলীগ সিট দখল করে। বল প্রয়োগ করে তারা বৈধ সিট থেকে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেয়। অথচ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ভুক্তভোগীকে সমঝোতার কথা বলে প্রশাসন। দীর্ঘদিন বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি চালু থাকায় হলে ছাত্রলীগের আগ্রাসন বাড়ছে।’

প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক একরামুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা একা সব কুলিয়ে উঠতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে সঙ্গে যৌথভাবে সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চালু রেখেছি। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা কাম্য।’

মাদকের থাবা : বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসহ বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে মাদক সেবন। আসক্ত শিক্ষার্থীর অধিকাংশ একাডেমিক পড়াশোনায় পিছিয়ে। অনেকের ইয়ার ড্রপ ও ড্রপআউটের ঘটনাও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, গত এক বছরে মাদক সেবনকালে ৫ শতাধিক আটক হয়েছে। এর মধ্যে মাদকদ্রব্যসহ আটক হয়েছে প্রায় ১৫০ জন। মুচলেকা দিয়ে অনেকে ছাড়া পেলেও ডজনখানেক পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগ আলী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে মাদক সেবনকালে অনেককে আটক করা হয়। পরে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। মাদক নির্মূলে প্রতি বছর সব শিক্ষার্থীর ডোপ টেস্ট করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিয়ম চালু করা জরুরি।’

প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, ‘ক্যাম্পাসে মাদক সেবন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। তবে নানা জটিলতায় তা নির্মূল সম্ভব হচ্ছে না।’

নিম্নমানের খাবার, বাড়ছে রোগব্যাধি : বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় নিম্নমানের খাবার সমস্যা দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বহুবার আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা। এতে উল্টো খাবারের দাম বাড়লেও মান বাড়েনি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলের পুষ্টিহীন খাবার মানসিক বিকাশ ব্যাহত করছে। অথচ প্রশাসনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্ডিস রোগে একজনের মৃত্যুসহ ১৩৭ শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক ডা. তবিবুর রহমান বলেন, ‘অনিরাপদ পানি ও খাদ্য গ্রহণে শিক্ষার্থীরা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।’ পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানি পরিবেশন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে হলে ট্যাংক পরিষ্কার না করা, অনেক দোকানে খাবারে সাপ্লাই পানি পরিবেশন এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুতকৃত খাবার খেয়ে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সাউদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসচেতনতায় বেশ কিছু কর্মসূচি চলমান। এ ছাড়া ক্যম্পাসে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার বিক্রি রোধেও কাজ করছি।’

উপাচার্যের কথা : এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জনবল সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। তবে খুব দ্রুতই এ সংকট নিরসন হবে। আবাসন সংকট নিরসনে দুটি নতুন হল নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছে। হলে সিট দখলকেন্দ্রিক সমস্যা নিরসনে সবার জবাবদিহি জরুরি। সেটার কাজ চলছে।’ তিনি বলেন, ‘মাদক সমস্যার অন্যতম কারণ ক্যাম্পাসে বহু প্রবেশপথ। এসব পথে বহিরাগতরা মাদক সরবরাহ করছে। এটা বন্ধের পাশাপাশি মাদক নির্মূলে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্ট প্রক্রিয়া নিয়েও ভাবছি। অন্যান্য সমস্যা নিরসনেও আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’

সর্বশেষ খবর