বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতির মৃত্যু

ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক স্ত্রীসহ চার দিনের রিমান্ডে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক স্ত্রীসহ চার দিনের রিমান্ডে

গৃহকর্মী হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতির মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে চার দিনের রিমান্ড দিয়েছে আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম সাইফুর রহমান এই রিমান্ড আদেশ দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার আবেদনে বলেছেন, জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদে আশফাকুল হকের দেওয়া তথ্যে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। এসব রহস্য উদঘাটন এবং সিসি ক্যামেরার হারিয়ে যাওয়া মেমোরি কার্ড উদ্ধারে তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে। এদিকে প্রীতির মা নমিতা উরাং বিচার চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। রাজধানী ঢাকায় সচেতন নাগরিক সমাজ আয়োজিত মানববন্ধনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নমিতা উরাং বলেন, আমার মেয়েকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মেয়ে হত্যার বিচার চাই। আমি আমার প্রীতি হত্যার বিচার চাই। সুষ্ঠু বিচার চাই। গতকাল বেলা ১২টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে নমিতা উরাং বলেন, আমরা গরিব মানুষ। এ জন্য আমার মেয়েকে এখানে (ঢাকায়) কাজের জন্য পাঠিয়েছিলাম। আমরা গরিব মানুষ বলে কি আপনাদের কোনো দয়া-মায়া নাই। এভাবে কি একটা গরিবের মেয়েকে বিল্ডিং থেকে ফালানো লাগে? এভাবে অত্যাচার করা লাগে? আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং বলেন, আমার মেয়েকে কাজের জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। আমরা এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার মেয়ের হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।

প্রীতির দাদা শংকর তাঁতী বলেন, আমরা চা শ্রমিক। আমরা সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকি। আমরা এখান থেকে অনেক দূরে থাকি। আমরা আমাদের সন্তানকে খাওয়াতে-পরাতে পারি না বলে ঢাকায় কাজ করতে পাঠাই। কিন্তু ও এখানে এসে নির্যাতিত হয়েছে, এটা আমরা মানতে পারি না। আমরা চাই প্রীতি উরাংয়ের মতো আর কোনো শিশু যেন এমন নির্যাতনের শিকার না হয়। আমাদের আর কোনো বাচ্চা যেন পথেঘাটে পড়ে না মরে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। প্রীতি উরাংয়ের চাচাতো বোন কবিতা উরাং বলেন, আমরা চা শ্রমিক। আমরা গরিব-দুঃখী মানুষ। আমরা আমার বোনকে কাজের জন্য ঢাকাতে পাঠিয়েছিলাম। এখন আমরা এতদূর থেকে ঢাকায় এসেছি আপনাদের কাছে, সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার জন্য। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এর বিচার চাই। এর আগে একই স্থানে প্রীতির মৃত্যুর বিচারের দাবিতে পৃথক মানববন্ধন করেছে গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক। সংগঠনটি এ ধরনের ঘটনা যেন আর না হয় সে বিষয়ে সরকার ও প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এই মানববন্ধন কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন ১২টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের জোট শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল ওয়াহেদ। সঞ্চালনা করেন গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী আবুল হোসেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুরশিদা আক্তার নাহার, ব্লাস্টের সিনিয়র আউটরিচ অফিসার আমান উল্লাহ। সংগঠনটি কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি উরাং হত্যাসহ সব গৃহকর্মী হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি পেশ করে।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, দেশব্যাপী গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষায় প্রণীত ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দেশে একের পর এক গৃহশ্রমিকের মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বিচারহীনতার কারণে দোষীরা বার বার গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের সাহস পায়। যদি এসব ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে সেই ভয়ে আর কেউ গৃহশ্রমিকদের নির্যাতনের সাহস দেখাবে না।

চার দিনের রিমান্ডে : জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল সৈয়দ আশফাকুল হক ও তানিয়া খন্দকারকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই নাজমুল হাসান।

তার রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামিদের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে তারা আলাদা আলাদা কারাগারে থাকায় ঘটনার বিষয়ে তাদের একত্রে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে তারা ঘটনা সংক্রান্তে অনেক রহস্যজনক তথ্য দিয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে ঘটনার মূল রহস্য কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। এ মামলার ঘটনাস্থলে সিসি ক্যামেরা থাকলেও কোনো মেমোরি কার্ড পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা কৌশলে বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান। ধারণা করা যাচ্ছে- ক্যামেরায় ঘটনার ভিডিও ধারণ থাকার ফলে আসামিরা ঘটনার পরপরই সেখান থেকে মামলার আলামত নষ্ট বা গোপন করার জন্য মেমোরি কার্ড লুকিয়ে রাখতে পারেন। এমতাবস্থায় তাদের নিয়ে বাসায় অভিযান চালালে মেমোরি কার্ড জব্দ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা এ মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এবং প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের লক্ষ্যে আসামিদের নিয়ে ঘটনার ভিডিও ধারণ করা ক্যামেরার মেমোরি কার্ড জব্দ অভিযান চালানো এবং উভয়কে মুখোমুখি নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডে পাওয়া একান্ত আবশ্যক। আসামিপক্ষে তাদের আইনজীবী জামিন আবেদন করেন। পরে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে প্রত্যেকের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আসকের উদ্বেগ ও বিচার দাবি : এ ঘটনায় গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ এবং দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। পাশাপাশি শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োগ বন্ধে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নের জোর আহ্বান জানানো হয়।

আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সলের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর শাহজাহান রোডের একটি বাড়ির নয় তলা থেকে পড়ে প্রীতি উরাং (১৫) নামে এক শিশু গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়। প্রীতির বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মিত্তিঙ্গা গ্রামে। তার বাবা লোকেশ উরাং একজন চা শ্রমিক। প্রীতি গত দুই বছর ধরে ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় কাজ করত। ঘটনার দিন সকালে প্রীতি উক্ত ভবনের নয় তলা থেকে পাশের দোতলা টিনশেডের ওপর পড়ে এবং সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান ওই বাড়ির ম্যানেজার। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় মামলার পর অভিযুক্তদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একই বাসায় গত বছরের ৬ আগস্ট ফেরদৌসি নামের আরেক শিশু গৃহকর্মীর লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আসক একই বাসায় অত্যন্ত কম সময়ের ব্যবধানে দুজন শিশুর হতাহতের ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে, পাশাপাশি, প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছে।

 

 

সর্বশেষ খবর