শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা অপরাধ

সাখাওয়াত কাওসার ও আলী আজম

বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা অপরাধ

গত ৩০ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা সদরের বারোয়ারি বটতলা মহল্লার একটি বাসা থেকে তিনজনের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলেন, ওই এলাকার বিকাশ চন্দ্র সরকার, তার স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার ও তাদের একমাত্র কন্যা ১৫ বছরের পারমিতা সরকার তুষি। অল্প সময়ের ব্যবধানে পুলিশ চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসা ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে নিজের মামা বিকাশ চন্দ্রকে সপরিবারে হত্যা করে তার আপন ভাগনে রাজীব কুমার ভৌমিক। নেপথ্য কারণ ছিল ব্যবসায়িক লেনদেন।

গ্রেফতারের পর রাজীব জানায়, রাজীবের খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন মামা বিকাশ। ব্যবসার লভ্যাংশসহ ২৬ লাখ টাকা বিকাশকে পরিশোধ করে সে। এ জন্য তাকে ৬ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ করতে হয়েছিল। এর পরও ৩৫ লাখ টাকা দাবি করছিলেন বিকাশ। এ নিয়ে মামা-ভাগনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। টাকার দাবিতে বোনের (রাজীবের মা) সঙ্গেও অসদাচরণ করেন বিকাশ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মামা, মামি ও মামাতো বোনকে হত্যা করে রাজীব। গত ১৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় বিএনপি নেতা হারুন অর রশিদকে কুপিয়ে হত্যা করে একই ইউনিয়নের নেওকা গ্রামের বাসিন্দা রুবেল মিয়া (৩৫)। নৃশংস এই খুনের দৃশ্য ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। এক মিনিট ৯ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, খুনের ঘটনায় পুলিশের হাতে আটক রুবেল একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে হারুন অর রশিদকে উপর্যুপরি কোপাচ্ছেন। হারুন নিস্তেজ অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিলেন। রুবেল একটি সাদা লুঙ্গি ও কালো রঙের সোয়েটার পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। রক্তে তার লুঙ্গি লাল হয়ে যায়। টানা কিছুক্ষণ কোপানোর পর দুই হাত ওপরে তুলে রুবেলকে উল্লাস করতে দেখা যায়। এরপর তিনি আরও দুটি কোপ দেন। শেষে রামদা হাতে বাজারের মধ্য দিয়ে চলে যান। এ তো গেল মাত্র দুটি ঘটনা। তবে এমন ঘটনা যেন মাঝেমধ্যেই ঘটছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ঘরে বাইরে এমনকি সর্বত্রই। ঘুণাক্ষরে কখনো কল্পনা করা হয়নি, তবে এমন ঘটনাই ঘটছে অহরহ। কাছের স্বজনদের আবির্ভাব হচ্ছে রীতিমতো জমদূতের রূপে। নৃশংসতাই যেন এখন শেষ কথা। তুচ্ছ কারণেই মানুষ হামলে পড়ছে অন্যের ওপর। আবার এসব বীভৎস ঘটনা প্রচার করছে সামাজিক মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা না থাকলে এর বিরূপ প্রভাব পড়তেই থাকবে। সনাতন সমাজ ব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসাম্য, দ্বন্দ্ব, লোভ ও হতাশা থেকেই মানুষ দিন দিন নৃশংস হয়ে উঠছে। যার সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়নের বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

তারা আরও বলছেন, অর্থলিপ্সা মানুষকে হিংস্র করে তুলছে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় অর্থশালীদের পক্ষেই থাকে সবকিছু। আইন, বিচারক কোনো কিছুই সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে নয়। ফলে তারা যখন আইনের শাসনের কথা ভাবে, তখন এই পথে যাওয়ার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় হিসেবে মনে করে। আবার একজন অপরাধী একটা অপরাধ করার পর সেটা ঢাকতে আরও একাধিক অপরাধ করে। এটা আমাদের সহজাত প্রবণতা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ২০২৩ সালে সারা দেশে ৫৭৪টি নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ১২৯টি। ধর্ষণের পর মারা গেছেন ৩৩ জন। আত্মহত্যা করেছেন তিনজন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। চেষ্টা চালানো হয়েছে ৯টি। ধর্ষণের পর মারা গেছে দুজন। ধর্ষণের বিষয়টি মানতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন একজন।

নৃশংসতার হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশুরাও। গত বছর শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। এদের মধ্যে ছয় বছরের নিচে চারজন এবং ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে ছিল ১৮ জন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩১টি। শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। মামলা হয়েছে ১২টি। তবে এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৭৯ জন নারী। একই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন। এ ছাড়া নির্যাতনের কারণে ৫১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলেও তথ্য দেয় সংস্থাটি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেঘলা সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে আমরা একটা ট্রানজেশনাল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, পরস্পরের সঙ্গে সৌহার্দ্য কমে যাওয়া, অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে যাওয়ার কারণে সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। তিনি বলেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে এর প্রভাব পড়ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ওপরও। এজন্য বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের উচিত হবে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো। বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে সামাজিকতা বাড়ানো যেতে পারে।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি খুলনার পাইকগাছায় হাত-পা বেঁধে চোখে সুপার গ্লু আঠা লাগিয়ে ও মুখে স্কসটেপ লাগিয়ে ডাকাতি করার সময় এক গৃহবধূ গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবেশীরা বলছেন, তার স্বামী ব্যবসায়ী কাজে গড়ইখালীতে ছিলেন। এ সুযোগে ডাকাতরা তার বাড়ি গিয়ে গৃহিণীকে জিম্মি করে। পরে কানের দুল ও নাকফুল ছিঁড়ে নেয়। বাড়ির আসবাবপত্র তছনছ করে আলমারি ও বাক্সে থাকা টাকা স্বর্ণালংকার লুটপাট করে। তারা ওই গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে। গুরুতর অবস্থায় তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন ও হাতের কবজি এবং পায়ের গোড়ালি কেটে ভিডিও ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের নৃশংসতার জানান দিয়েছিল সমাজের কিছু বখে যাওয়া কিশোর। এ ঘটনা সমাজের সচেতন মানুষের চিন্তায় নানাভাবে প্রভাব ফেলে। ভাবতে বাধ্য করে সমাজ সংস্কারকদের। সম্প্রতি ঝিনাইদহ জেলার ঘোষপাড়া এলাকার বরুণ ঘোষের সঙ্গে একই এলাকার তন্ময়সহ বেশ কয়েকজনের জমিজমা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। গত ৯ জানুয়ারি রাতে ইজিবাইকে করে বাসায় ফেরার সময় বরুণকে ইজিবাইক থেকে নামিয়ে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে দুর্বৃত্তরা। এক পর্যায়ে তার আঙুল, ডান হাতের কবজি ও বাম পা হাঁটু থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার চিৎকার শুনে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। গুরুতর অবস্থায় বরুণকে উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার কারণে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পরিবারেও। তাই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তাহলে সহিংসতা কমে আসবে। পারিবারিক সমস্যা পারিবারিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা না থাকলে রোমহর্ষক ঘটনা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। তখন সব ক্ষেত্রেই হতাশার জন্ম নেবে। সবার মনেই তৈরি হবে অস্থিরতার। একটা প্রজন্মের জন্য এটা কখনো প্রত্যাশিত নয়। তাই সামাজিক অস্থিরতার বিষয়টি তলানি থেকে খতিয়ে দেখে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত কর্তৃপক্ষের। নইলে আরও ভয়াবহ রূপ দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও ক্রিমিনোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, গত ২০-২৫ বছর আগে রিলেটিভলি দ্বন্দ্বের উৎস কম ছিল। সমস্যা হলে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করে নিত। সভ্যতার বিকাশে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন যখন হয়েছে, তখনই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এর মধ্যে সম্পত্তি একটা বড় কারণ হয়ে উঠছে। আগের তুলনায় জমির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। ফলে পরিবারের মধ্যেই পিতা, মাতা, ভাইবোন একে অপরের সঙ্গে বিরোধ বাড়ছে। জমির জন্য মাকে-বাবাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। ভাই ভাইকে ও বোনকে হত্যা করছে।

তিনি আরও বলেন, সভ্যতা একদিকে যেমন আমাদের ভালো কাজের উদাহরণ দিচ্ছে, ঠিক তেমনি আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, লোভ, ধর্ষণ, ড্রাগ বেড়ে যাওয়া, সামাজিক অসমতা, অস্ত্রের ব্যবহার এর বিপরীত চিত্র। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নত বিশ্বেও এটা রোগের মতো ছড়িয়ে গেছে।

সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার অভাব

সমাজের অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ

প্রতিশোধের মানসিকতায় অস্থিরতা বাড়ছে

 

সর্বশেষ খবর