শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

গুলির শব্দ এবার সেন্টমার্টিনে

আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের হস্তান্তর

নিজস্ব প্রতিবেদক

গুলির শব্দ এবার সেন্টমার্টিনে

আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ৩৩০ সীমান্তরক্ষীকে গতকাল হস্তান্তর করে বিজিবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ থামছেই না। গত কয়েকদিন ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও এবার মর্টার শেল ও গুলির বিকট শব্দ শোনা গেছে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন থেকে। গতকাল ভোর ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত তুমুল গোলাগুলির শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দ্বীপ দুটির বাসিন্দাদের মধ্যে।

টেকনাফের জালিয়া পাড়া ও গোলার মাঝামাঝি সীমান্তে বেলা ১২টা পর্যন্ত তুমুল গোলাগুলি ও মর্টার শেলের শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন শাহপরীর দ্বীপ ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদু সালাম। শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিন বলেন, ফজরের নামাজের পর থেকেই মিয়ানমার থেকে বিকট শব্দ ভেসে আসতে শুরু করে। ভয়ে অনেকেই ঘরে ঢুকে যায়। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে অন্তত এক শয়ের বেশি গুলির শব্দ শুনেছি। এর আগে কখনো সীমান্ত থেকে এভাবে গুলির শব্দ শোনা যায়নি। এদিকে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারাও গতকাল ভোর থেকে মর্টার শেল ও গুলির শব্দ শুনেছেন। স্থানীয়রা জানান, এই প্রথমবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে গোলাগুলির শব্দ সেন্টমার্টিন থেকে শোনা গেছে। বিকট শব্দ। দ্বীপের সাধারণ মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আবার হঠাৎ করে মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্তে মর্টার ও গুলির শব্দ ভেসে আসছে। তবে টেকনাফ সীমান্তে বিজিবি কঠোর নজরদারি রয়েছে।

এদিকে বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার রিজার্ভ ফোর্সেস আইন সক্রিয় করার মাধ্যমে অবসরে যাওয়া প্রবীণ সেনাদের আবারও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত মঙ্গলবার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং আইনটিতে সই করেন বলে জানা গেছে। আইন অনুযায়ী যেসব সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হবে তারা তাদের পেনশনের পাশাপাশি সামরিক প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত অন্যান্য সুবিধা পাবেন। অবসর গ্রহণ বা পদত্যাগ করার সময় যারা যে পদে ছিলেন তাদের একই পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।

আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের হস্তান্তর : বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হামলার মুখে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সেনাসদস্য, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যসহ ৩৩০ নাগরিককে ১২ দিনের মাথায় ফেরত নিয়েছে মিয়ানমার। গতকাল সকালে কক্সবাজারের ইনানী সৈকতে সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতার পর নৌবাহিনীর জেটিঘাট থেকে তাদের হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে তাদের হস্তান্তর করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।

বিজিপির কর্নেল মায়ো থুরা নাউংয়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল বিজিবির কাছ থেকে ৩৩০ মিয়ানমার নাগরিককে গ্রহণ করেন। এর আগে ভোর ৫টা থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম এবং টেকনাফের হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয়ের অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্প থেকে বিজিবির সতর্ক প্রহরায় ১২টি বাসে করে তাদের ইনানীতে আনা হয়। হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরুর আগে থেকেই সীমান্ত এলাকা এবং ইনানীতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি কোস্টগার্ড সদস্যরা নিয়োজিত ছিল সেখানে। গতকাল বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়নের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আশ্রয় গ্রহণকারী ৩০২ জন বিজিপি সদস্য, চারজন বিজিপি পরিবারের সদস্য, দুজন সেনা সদস্য, ১৮ জন ইমিগ্রেশন সদস্য এবং চারজন বেসাময়িক নাগরিকসহ মিয়ানমারের মোট ৩৩০ জন নাগরিককে সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। হস্তান্তর কার্যক্রম শেষে বিজিবি মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সে দেশের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এই সংঘর্ষের প্রভাব বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তেও এসে পড়ে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু, ঘুমধুম ও বাইশফাঁড়ি সীমান্তের বিপরীতে বিজিপির তুমব্রু রাইট ও লেফট ক্যাম্পে আক্রমণ করে। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী, পালংখালী এবং টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের বিপরীতে কাইচিং রং, মইদু, গদুদ্ধজ্য ও মংডু এলাকায়ও গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ফলে মিয়ানমারের বিজিপি, সেনা, পুলিশ, ইমিগ্রেশন ও বেসামরিক সদস্যরা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধৈর্য ধারণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রেখে বিজিবিকে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে বিজিবি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৩৩০ জনকে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত ৯ বিজিপি সদস্যকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

তিনি বলেন, গত ১১ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিজিপিসহ মিয়ানমারের ৩৩০ নাগরিককে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য বিজিবিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিজিবির রামু সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবীরের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশের প্রতিনিধির সমন্বয়ে সাত সদস্যের একটি প্রত্যাবাসন কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকালে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জাহাজে করে মিয়ানমারের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট বিজিপি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারের ইনানীর নৌবাহিনীর জেটিঘাটে আসে এবং বিজিবির কাছ থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৩৩০ জন নাগরিককে মিয়ানমারে নিয়ে যায়। বিজিবি জানিয়েছে, তাদের নিতে মিয়ানমার নৌ বাহিনীর একটি জাহাজ বাংলাদেশ সীমানায় এসে গভীর সাগরে অবস্থান করে। পর্যটকবাহী জাহাজ কর্ণফুলীতে করে ৩৩০ জনকে পৌঁছে দেওয়া হয় মিয়ানমারের ওই জাহাজে। সেখানেই হয় হস্তান্তর প্রক্রিয়া। ২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ১২ দিন ধরে কখনো প্রচণ্ড গোলাগুলি, আবার কখনো থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আক্রমণের মুখে উখিয়া সীমান্তের রহমতের বিল, টেকনাফের হোয়াইক্যং ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যসহ ৩৩০ জন আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র জমা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তারা এতদিন বিজিবি হেফাজতে ছিলেন।

সর্বশেষ খবর