শিরোনাম
শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
ডেইলি স্টার সাংবাদিকের গৃহকর্মী হত্যা

মেমোরি কার্ড খুঁজছে পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসার গৃহকর্মী প্রীতির মৃত্যুর বিচার দাবিতে গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে। রাজধানীর ফার্মগেট ডেইলি স্টার অফিসের সামনে মানববন্ধন করেছে সচেতন নাগরিক সমাজ। শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ ব্যানারে। ঢাকার বাইরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে মানববন্ধন করেছে চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্ট।

এদিকে প্রীতির মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, মোহাম্মদপুর থানায় চার দিনের রিমান্ডে থাকা ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাদের কাছে ঘটনাস্থলের সিসিটিভির মেমোরি কার্ড কোথায় রাখা হয়েছে তা জানতে চায় তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু জবাব না দিয়ে আশফাকুল নানা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তার স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ জানতে চেয়েছে, বার বার কেন তাদের বাসায় গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) আজিজুল হক বলেন, রিমান্ডে ওই দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে ঘটনাস্থলে থাকা সিসিটিভির মেমোরি কার্ডটি কোথায় আছে তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে তদন্তাধীন এ বিষয়ে এখনো বলার মতো কিছু নেই।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি ভবনের নয় তলায় সৈয়দ আশফাকুলের বাসা থেকে পড়ে মৃত্যু হয় কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি ওরাংয়ের। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় ডেইলি স্টার পত্রিকার কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে সচেতন নাগরিক সমাজ।

এ সময় মানববন্ধনে ‘বিচার চাই বিচার চাই, আশফাকুল দম্পতির বিচার চাই’ বলে মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে দেখা যায়।

মানববন্ধনে সচেতন নাগরিক সমাজের নেতা আবেদ হোসেন নিশাত বলেন, প্রীতি ওরাংয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকর যতদিন না হবে ততদিন পর্যন্ত আমরা আন্দোলনে রাজপথে থাকব। সাংবাদিক হিসেবে একজন সচেতন মানুষ আশফাকুল ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার। অথচ মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দুজন শিশু ও কিশোরী গৃহকর্মী তাদের নয় তলার ফ্ল্যাট থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের বিস্মিত করেছে। আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, প্রীতি ওরাংয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রমকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। এ কারণে বাধ্য হয়ে আমরা ডেইলি স্টার পত্রিকা অফিসের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করেছি।

তিনি বলেন, আমরা সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলতে চাই, দেশের আপামর জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের উচিত প্রীতির হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য মাঠে নামা। প্রীতি যে বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা, পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে বাধ্য হয়েছে ঢাকায় এসে বাসা-বাড়ির কাজ নিতে। অথচ তার ওপর অমানবিক নির্যাতন ও জোরপূর্বক ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। সমাজের সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবেও আমরা এটা মেনে নিতে পারি না।

সচেতন নাগরিক সমাজের আরেক নেতা নাইমুল ইসলাম নাঈম বলেন, অবিলম্বে প্রীতির হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ফাঁসি নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের প্রভাবশালী ও অর্থকড়ির মালিক হওয়ায় আশফাকুল হক বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। যে কোনো মূল্যে তাদের বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।

এদিন বিকাল ৪টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’ ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা বলেন, ডেইলি স্টারের মতো পত্রিকা যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে তারাই নিজেদের সম্মান বাঁচাতে আজকে নীরব ভূমিকা পালন করছে। তাদের নির্বাহী সম্পাদককে তারা বাঁচানোর চেষ্টা করছে। অথচ ন্যায় সবার জন্য সমান হওয়ার কথা ছিল। সব তথ্য-প্রমাণ আশফাকুলের বিরুদ্ধে যাওয়ার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি বিচার চলাকালীন সময়ে আশফাকুলকে সাসপেন্ডও করেনি। এতে বোঝা যায় তারা অন্যায়ের পক্ষ নিয়েছে। আশফাকুলকে ডেইলি স্টার থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং সুষ্ঠু তদন্ত করে তার বিচার করতে হবে।

সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, কলাম লেখক ও নারী নেত্রী ইলোরা দেওয়ান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দীন, লেখক সাহেদ কায়েস, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহম্মেদ, এক্টিভিস্ট জাকিয়া শিশির, চলচ্চিত্র নির্মাতা অপরাজিতা সঙ্গীতা, জীবনানন্দ দাস, গৃহকর্মী সংগঠনের নেত্রী জাকিয়া সুলতানা, নাসির উদ্দীন প্রিন্স, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজিম তিতিল। গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক লেখক প্রকাশক রবিন আহসান বলেন, যার বিরুদ্ধে একটা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে তাকে এখনো চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছে। অতিদ্রুত ডেইলি স্টার থেকে তাকে যেন অপসারণ করা হয় এবং সুষ্ঠু তদন্ত করে তার যথাযথ বিচার করা হয়। তিনি গ্রেফতার আছেন কিন্তু তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত তার বিচার করা উচিত।

ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল বলেন, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ড। এটা যদি হত্যাকাণ্ড না হতো, তাহলে ২ লাখ টাকা দিয়ে আপস করার চেষ্টা করা হতো না। এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নাটক সাজানো হচ্ছে। প্রথমে উচিত ছিল শ্রম আইনে মামলা করা। কিন্তু প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। আমরা চাই ডেইলি স্টার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ করবে। আমরা সাধারণ জনগণ ডেইলি স্টার পড়ি। কিন্তু তারা যদি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে আমরা ডেইলি স্টারকে বর্জন করব। যতদিন পর্যন্ত প্রীতি ওরাং ন্যায় বিচার না পাবে ততদিন আমরা সংগ্রাম করে যাব।

গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক আকরাম হোসেন বলেন, আশফাকুল হকের বাসার বারান্দা থেকে গৃহকর্মী ফেরদৌসী পড়ে গিয়ে কোনো রকম প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। তার মায়ের ভাষ্য ছিল মেয়েটির যৌনাঙ্গের অপারেশন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো রিপোর্টেই তা নাই। অর্থাৎ তদন্ত কর্মকর্তারা তার বিপক্ষে। শ্রেণি বৈষম্য বলে একটা কথা আছে। আদালতে সাংবাদিকরা আশফাকুলের ছবি তুলতে গেলে ডেইলি স্টারের কর্মীরা ধ্বস্তাধস্তি করে। আজকে একজন রাজনীতিবিদ হলে ডেইলি স্টার কী করত? আজকে ডেইলি স্টারের কাপড় খুলে গেছে তার কর্মী রক্ষা করতে গিয়ে। তারা তা বুঝতে পারছে না। অপরাজিতা সঙ্গীতা বলেন, যদি আপনারা ভেবে থাকেন ডেইলি স্টার একটি পাওয়ারফুল পত্রিকা তাই এই নির্বাহী সম্পাদক ছাড় পেয়ে যাবেন তাহলে ভুল ভাবছেন। এর শেষ না দেখে আমরা কোথাও যাচ্ছি না।

সালেহ আহম্মেদ বলেন, ডেইলি স্টারের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি পত্রিকা যারা দেশের গণতন্ত্র, অনাচার, অর্থনীতি, রাজনীতি সব বিষয় নিয়ে নিউজ করেন সেই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের বাসায় পরপর যেসব ঘটনা ঘটেছে তাকে কীভাবে এখনো পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের জায়গায় বসিয়ে রাখা হয়েছে তা বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায়।

আমাদের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানিয়েছে, প্রীতি ওরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর রহস্য দ্রুত উদঘাটন করে এর বিচারের দাবিতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে মানববন্ধন হয়েছে। গতকাল শ্রীমঙ্গলের চৌমোহনা চত্বরে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স ও মৌলভীবাজার চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্টের যৌথ আয়োজনে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের প্রকল্প সমন্বয়কারী পারভেজ কৈরীর সঞ্চালনায় ও মৌলভীবাজার চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্টের প্রধান নির্বাহী পরিমল সিং বাড়াইকের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, আমি একজন মিডিয়া কর্মী হয়ে আজ একটি মিডিয়া কর্মীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হচ্ছে। যিনি একটি স্বনামধন্য পত্রিকার কর্ণধার, তার বিরুদ্ধে কথা বলতে হচ্ছে। তার ফ্ল্যাট থেকে প্রীতি ওরাংকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সে বাঁচার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাঁচতে পারেনি। এর আগে প্রীতি ওই বাসা থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। তারা তাকে চলে যেতে দেয়নি। ঘটনার পর বিভিন্ন বর্ণনা দেখে বলা যায়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এই মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারি না, এই মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে দেশে আর কোনো গৃহকর্মী হত্যার ঘটনা ঘটবে না। চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্টের উপদেষ্টা দীলিপ কৈরী বলেন, প্রীতির মৃত্যু ঘটনাটি চা বাগানের কোনো সবুজ ঘেরা স্থানে নয়, একেবারে আলোঝলমল নগরী রাজধানী ঢাকার একটি অভিজাত ভবনে। প্রীতি কমলগঞ্জের মিরতিংগা চা বাগানের একেবারেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। একটু ভালো থাকার আশায় এবং মেয়ে যাতে একটু ভালো খেতে পারে, জামাকাপড় পরতে পারে, তার আয় দিয়ে সংসারে একটু সচ্ছলতা আসে সেই আশায় প্রীতিকে কাজে পাঠিয়ে ছিলেন তার মা-বাবা। কিন্তু মেয়েটি লাশ হয়ে ফিরে এলো। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

 

সর্বশেষ খবর