সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাক্সবন্দি যন্ত্রে বেহাল স্বাস্থ্যসেবা

একবার অচল হলে আর সচল হয় না ♦ জনবল নিয়োগ না দিয়েই পাঠানো হয়েছে যন্ত্রপাতি ♦ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে হয় রোগীদের ♦ সেবা দিতে অসুবিধায় চিকিৎসকরা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বাক্সবন্দি যন্ত্রে বেহাল স্বাস্থ্যসেবা

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের বারান্দায় বাক্সবন্দি যন্ত্রপাতি পড়ে আছে পাঁচ বছর ধরে

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ১০ কোটি টাকা মূল্যের ‘লিনিয়ার এক্সিলেটর’ মেশিন ১২ বছর ধরে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যতম জরুরি রেডিওথেরাপি মেশিন ছয়টি। এর চারটিই নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। দুটি মেশিন দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা। সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী ও স্বজনদের।

এ চিত্র শুধু দুটি হাসপাতালের নয়, দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে বছরের পর বছর যন্ত্রপাতি নষ্ট পড়ে রয়েছে। অনেক জায়গায় বাক্সবন্দি অবস্থায় যন্ত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে, এমআরআই মেশিন বসানো হলেও তা আর চালু করা হয়নি। এসব মেশিন পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি জনবল। ফলে সরকারি হাসপাতালে দামি মেশিন থাকলেও বাড়তি খরচ করে ছুটতে হয় ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।  

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকাসহ সারা দেশের অনেক হাসপাতালেই যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে আছে। আমি বিভাগ ও জেলা হাসপাতালগুলো ঘুরে সমস্যা চিহ্নিত করছি। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর বিভিন্ন সমস্যা ঘুরে দেখলাম। এরপর উত্তরবঙ্গসহ অন্য বিভাগেও যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। সমস্যা শনাক্ত করে প্রায়োরিটি বিবেচনায় সমাধান করব। জনবল সংকট কাটানোরও চেষ্টা করছি। সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সচল হলে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ আরও বাড়বে।’

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা থেকে জানান, ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৮ বছর ধরে বাক্সবন্দি থেকে নষ্ট  হয়ে গেছে জেনারেটর। কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি পাঁচ বছর ধরে নষ্ট হয়ে আছে। প্রায় দুই বছর বাক্সবন্দি থাকার পরও জরাজীর্ণ ভবনে নতুন এক্সরে মেশিন স্থাপন করা যায়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজাউল করিম জানান, এখানে অবকাঠামো সংকটের কারণে নতুন চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদাপত্রও দেওয়া হয়নি। হাসপাতালে এক্সরে মেশিনের ভাঙা কিছু অংশ, ডেন্টালের কিছু যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বটিয়াঘাটা উপজেলা হাসপাতালে এক্সরে, অটোক্লাভ মেশিনসহ ২২ ধরনের মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে ছয় বছর ধরে এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. সবিজুর রহমান জানান, উপজেলা পর্যায়ে কোনো যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি অবস্থায় নেই। ব্যবহার হতে হতে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো মেরামতের অযোগ্য তার চাহিদাপত্র তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। কয়রা ও দাকোপের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এখানে নির্মাণকাজ শেষ হলে চাহিদামতো যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে।

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম থেকে জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটি প্রায় চার বছর ধরে নষ্ট। একইভাবে সিটিস্ক্যান মেশিনটিও নষ্ট দীর্ঘদিন ধরে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটি প্রায় ছয় বছর ধরে নষ্ট। দুটি এক্সরে মেশিনের মধ্যে একটি নষ্ট দীর্ঘদিন ধরে। এভাবে নষ্ট, অচল এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়েই চলছে চট্টগ্রামের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা। জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের সদস্যসচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবা বড়ই অপ্রতুল। কিন্তু যা আছে তাতেও যদি জোড়াতালি অবস্থা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়।

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, এখানে জনবল সংকট আছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা কিছুদিন আগেও লিখিত জানিয়েছি।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটি দীর্ঘদিন ধরেই পড়ে আছে। এটি নিয়ে মামলা চলতে থাকায় কিছু করা যাচ্ছে না। আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। চমেক হাসপাতালে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে ১৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা মূল্যের দুটি এমআরআই মেশিন। হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের দুটি সিটিস্ক্যান মেশিনের মধ্যে একটি অচল পড়ে আছে। দুটি এনজিওগ্রাম মেশিনের একটি অচল পড়ে আছে। কার্ডিওলজি বিভাগের দুটি ক্যাথল্যাব মেশিনের একটি অচল পড়ে আছে। দুটি কোলনস্কপি মেশিন, এন্ডোসকপি মেশিন, দুটি ব্রঙ্কোসকপি মেশিন, একটি এক্সট্রাকরপোরিয়াল শক ওয়েভ লিথোট্রিপসি (ইএসডব্লিউএল) মেশিন অচল পড়ে আছে। জেনারেল হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটি নষ্ট প্রায় ছয় বছর ধরে।

রাহাত খান, বরিশাল থেকে জানান, বরিশাল বিভাগের মধ্যে শেরবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা একমাত্র এনজিওগ্রাম মেশিনটি দুই মাসের বেশি বন্ধ পড়ে আছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও জনবল না থাকায় আধুনিক এ মেশিনটির সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা। শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ডা. এম সালেহ উদ্দীনকে পটুয়াখালীতে বদলি করার পর থেকে এনজিওগ্রাম মেশিনটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এ কারণে হৃদরোগীদের ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

কাজী শাহেদ, রাজশাহী থেকে জানান, রাজশাহী মহানগরীর সিপাইপাড়ায় রাজশাহী সদর হাসপাতাল এক বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে। দেড় যুগ ধরে বন্ধ থাকার পড় ২০২১ সালে জেলায় অতিরিক্ত করোনা রোগীর চাপে বন্ধ হাসপাতালটি ফের চালুর কথা ভাবা হয়। ৬ কোটি টাকার বেশি খরচ করে হয় সংস্কার কাজ। সেই কাজ শেষ হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তবু এক বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে হাসপাতালটি। জনবলের অনুমোদন না হওয়ার কারণেই হাসপাতালটি এখনো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মো. ফারুক বলেন, জনবলের বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। জনবল পেলে হাসপাতালটি চালু করা হবে।

মো. কাবুল উদ্দিন খান, মানিকগঞ্জ থেকে জানান, মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে এমআরআই মেশিন কোনো কাজে আসছে না। সাত বছর পেরিয়ে গেলেও আইসিইউ সুবিধা পাচ্ছে না রোগীরা। ২০১৭ সালে সদর হাসপাতালে আইসিইউ চালু করা হয়। মাত্র এক মাস চালু থাকার পর অদৃশ্য কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। চার বছর আগে এমআরআই সংযোজন করা হলেও চালু করা হয়নি। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক কে এম রাসেল বলেন, ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও নার্স ব্যতীত বাড়েনি এর জনবল।

দেবাশীষ বিশ্বাস, রাজবাড়ী থেকে জানান, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জ¦ালানি সংকটের কারণ দেখিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী বহন বন্ধ রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফারসিম তারান্নুম হক বলেন, ‘সরকারিভাবে তেলের বরাদ্দ না থাকায় আমরা বিপাকে পড়েছি। রাজবাড়ী-১ আসনের এমপি কাজী কেরামত আলী, গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ হাসপাতাল পরিচালনার কমিটির সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন।’

মনিরুল ইসলাম মনি, সাতক্ষীরা থেকে জানান, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসের বারান্দায় দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মূলের চিকিৎসা সরঞ্জাম। যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় জব্দ হওয়ায় ওইসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার জন্য অনুমতি চেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালকের অধিদফতরে বিভিন্ন সময়ে মোট ছয়বার চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো অনুমতি পাওয়া যায়নি। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে, ৪টি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন, ১৮টি নেবুলাইজার মেশিন, ৪টি আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন, ১টি রেটিনোস্কপ মেশিন, সিলিং ওটি যন্ত্রাংশ এক সেট, স্টিল ল্যাম্প একটি, এক সেট ডেন্টাল যন্ত্রাংশ, একটি সাকশান ইউনিটসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। চিকিৎসকরা বলছেন, বছরের পর বছর মূল্যবান এসব আধুনিক চিকিৎসা মেশিন ও যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার না করার কারণে তা নষ্ট হতে বসেছে। সাতক্ষীরার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. জয়ন্ত সরকার জানান, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরের বরাদ্দ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কেনা মামামালে অনিয়মের অভিযোগ থাকায় দুদকে মামলা চলছে। হাসপাতালে বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায় কি না তা বিবেচনা করতে সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর এ পর্যন্ত ছয়বার চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর