মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ম্যানেজ করেই চলে সবকিছু

সাখাওয়াত কাওসার

১৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টা। কারওয়ান বাজার মৎস্য আড়তের পেছন। রেললাইন লাগোয়া। একটু দূরেই এফডিসি বস্তি। হাতিরঝিল সাইড থেকে কারওয়ান বাজার মোড়ের দিকে যাচ্ছিল একটি সাদা প্রাইভেট কার। তবে রেললাইন পার হওয়ার আগেই গতি কমতে থাকে গাড়িটির। প্রাইভেট কার লক্ষ্য করে হঠাৎই এক যুবকের আগমন। মনে হচ্ছিল তারা আগে থেকেই পরিচিত। স্যার লাগবে নাকি? সবই আছে স্যার। অজ্ঞাত যুবকটির এমন প্রশ্নের উত্তর কী ছিল বোঝা যাচ্ছিল না। এর মাত্র ৫ মিনিট পর অনেকটা একই ভঙ্গিতে আসছিল একটি মোটরসাইকেল। পেছনের সিটে থাকা আরোহীকে কিছু একটা দিয়ে টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছিল আরও এক যুবক। বিষয়টি নিয়ে কারওয়ানবাজারের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলছিলেন, ‘ভাই, এ চিত্র তো বহুদিনের। হুদাই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলা হয়। তাইলে এখানে প্রকাশ্যে কী দেখছেন?’ প্রশ্ন ছিল তাদের।

রাত পৌনে ৩টা। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প। এ ক্যাম্প ঘিরে গজনবি, বাবর, শাহজাহান ও হুমায়ুন রোডে তল্লাশিচৌকিও রয়েছে। তবে মাদকের অন্যতম চিহ্নিত স্পট জেনেভা ক্যাম্প ঠিকই সরব। ক্যাম্পের ঠিক বাইরে একটু দূরে দূরে টুলে বসে সবকিছু তদারকি করছিলেন কয়েক যুবক। কিছু সময় পর পর মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারে আসা কাস্টমারদের ছোট ছোট শিশুদের দিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছিল মাদক। এসব দৃশ্যে থাকা চরিত্ররা আগে থেকেই পূর্বপরিচিত বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না। হয়তো স্পটে আসার আগে নিজেদের মধ্যে কথা বলেই এসেছেনে গ্রাহকরা। জেনেভা ক্যাম্প স্পটে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ীরাই পুলিশ ম্যানেজ করে। তবে হিসাবে গরমিল হলে পুলিশ গ্রাহকদের ঝামেলা করে। ক্যাম্পে আগের মতোই ব্যবসা করে যাচ্ছে সোলেমান ওরফে সালমান, জুম্মন, মোল্লা আসাদ। সঙ্গে রয়েছে খুরশিদ, শাহজাদা, পাপ্পু, মুন্না, চোরা সেলিম, তুইতে, কাল্লু, রাজু, তাবলিস আসলাম, গাল কাটা মনু ও রেহানা। জানা গেছে, কারওয়ানবাজার ও জেনেভা ক্যাম্পের থেকেও ভয়ংকর স্পট হাজারীবাগ বেড়িবাঁধের বুদ্ধিজীবী কবরস্থান লাগোয়া এলাকা। প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসার পাশাপাশি মাঝে মাঝেই ঘটছে ছিনতাই। রাত গভীর হওয়ার বিপরীতে সড়কে কমতে থাকে যানবাহনের সংখ্যা। তবে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে ভোঁ-ভোঁ করে ছুটে চলা আগন্তুকদের মোটরসাইকেল। সুযোগ বুঝে তারা হামলে পড়ে পথচারী, রিকশা কিংবা অটোরিকশায় যাওয়া যাত্রীদের ওপর। তাদের দাপট অব্যাহত থাকে ভোর অবধি। তবে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আড়ালে চলে যায় তারা। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকায় পুলিশি টহল নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ সড়কের ট্রাফিক পুলিশবক্সগুলো ফাঁকা, তালাবদ্ধ। তবে সড়কের কোথাও কোথাও গতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নামমাত্র ব্যারিকেড স্থাপন করেছে পুলিশ। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন দূরে কোথাও। রাজধানীর ফুটওভার ব্রিজগুলো রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় হিজড়া, মাদকসেবী ও ভবঘুরেদের দখলে। এ কারণে অনেক পথচারী প্রয়োজন থাকার পরও ফুটওভার ব্রিজে উঠতে সাহস পান না। ফার্মগেট, মৎস্য ভবন ও পরীবাগের ফুটওভার ব্রিজটিতে দীর্ঘদিন ধরেই এমন পরিবেশ বিরাজ করছে। পাঁচ তারকা সোনারগাঁও হোটেলের বিপরীতে পান্থকুঞ্জ এবং পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঠিক পেছন থেকে রমনা পার্কে সীমানাঘেঁষা প্রায় আধা কিলোমিটার পথ দীর্ঘদিন ধরেই দখলে চলে যায় হিজড়া ও নিশিকন্যাদের। মাঝে মাঝে নামকাওয়াস্তে পুলিশ অভিযান চালায়। তবে ঘুরে ফিরে একই দৃশ্য থাকে ওই আধা কিমিতে। সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিনের কাছে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেখুন নগরবাসীকে নিরাপদে রাখতে আমরা কাজ করে যচ্ছি। পুলিশের টহল-চেকপোস্ট সবই বাড়ানো হয়েছে। তবে সব এলাকায় রাতে ট্রাফিক পুলিশ রাখা হয় না। সেখানে থানার টহল টিম কাজ করে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অপরাধীদের নিয়মিতই গ্রেফতার করা হয়। তবে জামিনে বেরিয়ে তারা একই অপরাধে জড়াচ্ছে। ছিনতাই প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠন করার পাশাপাশি আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।’ জানা গেছে, মূলত রাত ১০টার পর থেকেই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারীরা।

একটি মোটরসাইকেলে দুজন ছিনতাইকারী ধারালো বা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন সড়কে ঘুরতে থাকে। যেসব সড়কে যানবাহন কম থাকে এবং পর্যাপ্ত আলো থাকে না, সেসব এলাকার রিকশাযাত্রী বা পথচারীদের টার্গেট করে তারা। চক্রটি এক জায়গায় ছিনতাই শেষে অন্য সড়কে চলে যায়। একই কৌশল অবলম্বন করে প্রাইভেট কারযোগে ছিনতাই করা চক্রটিও। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ভোরে বাস, রেল ও নৌ টার্মিনালে যাত্রীরা এসে নামেন। ভোরের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যাত্রীরা আসার সময় ছিনতাইকারীরা তাদের টার্গেট করে। এদিকে রাতভর দায়িত্ব পালন শেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তখন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে থাকেন। ফলে এ সময়টাতেই বেশি সক্রিয় থাকে ছিনতাইকারীরা। এর বাইরে সকালে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় কর্মজীবী নারী-পুরুষ যখন বের হন, তখনও ওত পেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার নিয়ে তাদের ব্যাগ ছোঁ মেরে নিয়ে যায় কিংবা পথ আটকে সর্বস্ব কেড়ে নেয় চক্রটি। গত অক্টোবরে ও ২ ফেব্রুয়ারি রাতে দুই দফায় রাজধানীর সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকা বঙ্গভবনের সামনের সড়কে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন দৈনিক ইনকিলাবের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল। দুই দফায়ই তার সঙ্গের নগদ টাকা ও সেলফোন নিয়ে যায়। তিনি বলছিলেন, ছিনতাইকারীরা ওই সময় আরও কয়েকটি রিকশা আটকে যাত্রীদের মালামাল ছিনিয়ে নেয়। ওই সময়গুলোয় ঘটনাস্থলের আশপাশে পুলিশের কোনো টহল ছিল না বলে মন্তব্য তার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর