বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিদেশে ছড়িয়েছে বাংলা অনাগ্রহ দেশে

জিন্নাতুন নূর

বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন শহরে নির্দিষ্ট স্থানগুলোয় এখন চোখে পড়ে সারি সারি বাংলা সাইনবোর্ড। কান পাতলেই শোনা যায় বাংলায় কথাবার্তা। কিছু শহরে পুরোপুরি বাংলা ভাষায় করা যায় সব কাজ। কেনাকাটা থেকে শুরু করে চিকিৎসা সবই করা যায় বাংলায়। ভিন্ন কোনো ভাষায় কথা বলার প্রয়োজনও হয় না অনেক স্থানে। প্রবাসীদের মাধ্যমে বাংলা ভাষার এ বিস্তারের পাশাপাশি বিদেশিদের বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণাও বেড়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলা উপেক্ষা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিদেশি ভাষা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমে তো বটেই, বাংলা মাধ্যমেও এখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

মার্কিন মুলুকের নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে ঢুকে পড়লে যে-কারও মনে হতে পারে বাংলাদেশে এসে পড়েছে। এখানে বেশ কয়েকটি সড়ক পুরোপুরিই বাংলাদেশিদের দখলে। এখানকার ভবন, স্থাপনা, দোকানপাটের অনেকটিই বাংলাদেশিদের তত্ত্বাবধানে চলে। জ্যাকসন হাইটসকে অনেকে নিউইয়র্কের গুলিস্তানও বলে থাকেন। ছুটির দিনে রাস্তায় হাঁটলে যার সঙ্গেই ধাক্কা লাগবে, সে-ই কথা বলবে বাংলায়। শুধু নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস নয়, এখন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসের থার্ড স্ট্রিট ও আলেকজান্দ্রিয়া অ্যাভিনিউর মাঝামাঝি এলাকাটিতে গেলেও চোখে পড়ে বাংলা ভাষার বাংলাবাজার, স্বদেশ, দেশি, আলাদিন নানা নামের সাইনবোর্ড। প্রায় এক দশক আগে এ জায়গাটি ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামে স্বীকৃতি দিয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস শহর কর্তৃপক্ষ। লিটল বাংলাদেশকে লস অ্যাঞ্জেলেসের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ বললে অত্যুক্তি মনে হবে না কারও। কানাডার টরন্টোর ডানফোর্ড অ্যাভিনিউতেও দেখা মেলে বাংলা সাইনবোর্ডের। যুক্তরাজ্যের পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেন ও আশপাশ এলাকা বেশ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশি অভিবাসী অধ্যুষিত। অনেক দিন ধরেই এলাকাটির আনুষ্ঠানিক নাম বাংলাটাউন। এখানকার সড়কগুলোর নামও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা। লন্ডনের তিনটি ডিস্ট্রিক্ট-ক্যামডেন, নিউহ্যাম ও টাওয়ার হ্যামলেটসে ‘বাংলা’ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা। সিঙ্গাপুরের মোস্তফা সেন্টারের কাছে রয়েছে মিনি বাংলাদেশ। এখানে পান-বিড়ি, ফ্লেক্সিলোড, ইন্টারনেট, সেলুন, বিকাশ-বাংলায় কী লেখা নেই রাস্তার পাশের দোকানের সাইনবোর্ডে! রয়েছে ঢাকা রেস্টুরেন্ট, হীরাঝিল রেস্টুরেন্ট এবং কম খরচে থাকাখাওয়ার প্রতিষ্ঠানের বাংলা ভাষার সাইনবোর্ড। শুধু এসব শহরেই নয়, একই রকম এলাকা আছে সৌদি আরবের জেদ্দা শহরের মুসনা, গুলিল, পবিত্র মক্কা-মদিনা; দুবাই, বাহরাইন, ওমান, কাতার, ইতালির রোম, স্পেনের মাদ্রিদ, বার্সেলোনা; জার্মানির বার্লিন, গ্রিসের এথেন্স, জাপানের টোকিও, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, জোহানেসবার্গ, থাইল্যান্ডের ব্যাংককের সুকুমভিতসহ বিভিন্ন দেশে। এসব শহরের এক বা একাধিক এলাকায় বাঙালিপাড়া, বাঙালিবাজার বা বাঙালিদের মিলনক্ষেত্র গড়ে তুলতে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত হওয়ায় চীনে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। সে দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে শুরু হয়েছে গবেষণা। বাংলা ভাষার কোর্স চালু হয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নিউইয়র্ক, সিডনি, লন্ডন, প্যারিসসহ বিভিন্ন শহরে এখন বেশ কয়েকটি বাংলা কাগজ বের হয়, বাংলা বইয়ের দোকানও আছে এসব শহরে। নিউইয়র্কে আধা ডজন বাংলা কমিউনিটি টেলিভিশনও চালু হয়েছে। এ শহরগুলোসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ শহর, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপসহ প্রবাসে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো সম্ভব শুধু বাংলায় কথা বলে। বিশ্বের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বাংলা ভাষার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ তৈরির সোপান হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। ফলে সেখানেও বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। প্রবাসীদের আগ্রহেই বিভিন্ন শহরে তৈরি হয়েছে ভাষাশহীদদের স্মরণের শহীদ মিনারও। জার্মানির বন শহরের বাসিন্দা এবং জার্মানভিত্তিক অনলাইন মিডিয়া ‘আওয়ার ভয়েস’-এর এডিটর ইন চিফ এ এইচ এম আবদুল হাই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের এখানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রতিবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এসব অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার গান, আবৃত্তি ও আলোচনার আয়োজন থাকে। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দেওয়া।’ গবেষকরা বলছেন, বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি লোক এখন বাংলায় কথা বলছে। ভাষা গবেষকদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখে। ৩০ দেশের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। এখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালিও বাংলা ভাষায় শিক্ষা ও গবেষণা করছে। মূলত ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি লাভ করেছে বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত-গবেষকের মাঝে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নতুন আগ্রহ দেখা দিয়েছে। ফলে বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ সবচেয়ে পুরনো। এ ছাড়া শিকাগো, ইন্ডিয়ানা, মেলবোর্ন, হাইডেলবার্গ, প্যারিস, টরন্টো, অটোয়া, এডিনবার্গ, সরবোর্ন, মস্কো, প্যাট্রিস লুলুম্বা, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। পিকিং, প্রাগ, ওয়ারশ, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ কার্যক্রম শুরু করেছে।

২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর ইন্টারন্যাশনালাইজড ডোমেইন নেম বাংলাদেশকে ডটবাংলা ডোমেইন ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এ ডোমেইনের ফলে সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী মানুষ ইন্টারনেটে নিজের ভাষায়ই বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারছে। তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বাংলাকে বিশ্বের আনাচকানাচে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীন। হরেকরকম বাংলা অ্যাপস তৈরি করা হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তবে দেশের বাইরে বাংলা নিয়ে আগ্রহ বাড়লেও দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিাবকরাই সুচিন্তিতভাবে ছোট থেকেই বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাংলা উপেক্ষা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিদেশি ভাষা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যম তো বটেই, বাংলা মাধ্যমেও এখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদের মধ্যে বাংলা শব্দের ভুল বানান ও উচ্চারণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বাংলা অনেক শব্দের অর্থই জানে না কিন্তু ইংরেজিতে একই শব্দটি বুঝতে পারে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে বিদেশি সংস্কৃতি। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রচারপত্রে, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ডে বাংলা উপেক্ষা করা হচ্ছে। উচ্চ আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও সাইনবোর্ড, বিলবোর্ডে বাংলা নাম ব্যবহার না করে ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। সমাজমাধ্যমের এই যুগে ফেসবুক ও ইউটিউবে দেশের সোশ্যাল ইনফøুয়েন্সাররা যেসব ব্লগ বানাচ্ছেন সেখানে ভুল বাংলা ব্যবহার হচ্ছে এবং কেউ কেউ অনর্গল ইংরেজিতেই কথা বলছেন; যা তরুণ প্রজন্মকে বাংলা ভাষার প্রতি নিরুৎসাহ করছে। বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে বাংলা ভাষার প্রতি যে অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছে তা ঠিক নয়। নিজেদের মর্যাদার জায়গাটি সমুন্নত রাখা উচিত। ভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের এ বিষয়ে মনোযোগী হতে অনুরোধ করছি।’ যে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়বে তাদের এ জায়গাগুলোয় ঠিকভাবে মানসিকভাবে তৈরি হতে দেওয়া উচিত বলেও সেলিনা হোসেন মন্তব্য করেন।

 

সর্বশেষ খবর