বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

খতনায় আরও এক শিশুর মৃত্যু, চিকিৎসক গ্রেফতার হাসপাতাল সিলগালা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যু নিয়ে আলোচনার মধ্যে একইভাবে আরও এক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মঙ্গলবার রাতে খতনা করাতে গিয়ে ওই শিশুর মৃত্যু হয়। ঘটনার পর সেখানে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার পর ঘটনায় জড়িত ডা. এস এম মুক্তাদির ও ডা. মাহবুব মোরশেদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল এসব তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান। তিনি বলেন, ‘অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার জন্য হাসপাতালের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের শুধু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন আছে। হাসপাতালের অনুমোদন নেই। তাই এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা জেনেছি সামান্য একটা মুসলমানির জন্য শিশু আহনাফ তাহমিদ আয়হামকে (১০) এ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ডা. মুক্তাদির নামে একজন এ সুন্নতে খতনার সার্জন ছিলেন, আর ডা. মাহবুব শিশুটির অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ছিলেন। অভিযোগ অনুযায়ী অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার সময় শিশুটিকে অজ্ঞান করার পর আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে আমরা গণমাধ্যমে ঘটনাটি জানতে পেরেছি।’ শিশুটির পরিবারের সদস্যরা জানান, খতনা করাতে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফখরুল আলম ও তার স্ত্রী খায়রুন নাহার তাদের বড় সন্তান আয়হামকে মালিবাগের ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করান। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি। তাদের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার কথা থাকলেও ফুল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয় আয়হামকে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনার পর যে চিকিৎসকের অধীনে ভর্তি করা হয়েছিল তিনি সেখান থেকে চলে যান। এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেছেন শিশুটির বাবা ফখরুল আলম। মামলার পর দুই চিকিৎসককে গ্রেফতার করে পুলিশ। শিশু আয়হামের মৃত্যুর ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন তারা বাবা-মা ও স্বজনরা। আয়হাম আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। পড়াশোনায় মনোযোগী থাকায় তাকে ঘিরে ছিল বাবা-মার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। কিন্তু আয়হাম এখন দূর আকাশের তারা। ফখরুল আলম বলেন, ‘আমি তাদের পা পর্যন্ত ধরেছি। বলেছি কিছু একটা ব্যবস্থা করেন। তারা বলে ঠিক হয়ে যাবে, এই যে দেখেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু এর আগেই ডেড। ঘটনার পর আয়হামের মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যান হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্টাফরা।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গের সামনে আয়হামের বাবা ফখরুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ছেলেকে তো ওটিতে ঢুকিয়ে দিলাম। ও বলছিল একটু ভয় লাগছিল। আমি বলেছিলাম, বাবা কোনো সমস্যা নেই, আল্লাহ ভরসা। এরপর ওটিতে ঢুকল আর সব শেষ! আমার ছেলে খুব উৎফুল্ল মনে ওটিতে ঢুকেছিল, খুব উৎফুল্লভাবে। তার খতনা করানো হবে, এতে সে খুব খুশি ছিল। আমার ছেলে নিয়মিত স্কুলে যেত। সে ক্লাস ক্যাপ্টেন এবং স্কাউটেও জয়েন করেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার সুস্থ সন্তানকে নিয়ে গেলাম আর পেলাম মৃত অবস্থায়। ১১ হাজার টাকা চুক্তিতে সুন্নতে খতনা করার জন্য ওই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম। এ মৃত্যুর দায় ডা. মুক্তাদিরসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবার।’ তিনি এর বিচার দাবি করে বলেন, ‘আমার মতো যেন কোনো বাবা-মা চিকিৎসকের ভুলে সন্তান না হারান।’ আয়হামদের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার আলেখাঁরচর গ্রামে। বর্তমানে ২৯০/১ এ খিলগাঁও রেলগেটে থাকে। ফখরুল ও খায়রুন দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে আয়হাম বড়। ছোট ছেলের নাম অহিন আলম (৬)। সে ফয়জুর রহমান আইডিয়াল স্কুলের ক্লাস ওয়ানের শিক্ষার্থী। ফখরুল রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ী। ডিএমপির হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আওলাদ হোসেন বলেন, শিশুটির বাবা তিনজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত তিন-চার জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি চিকিৎসকের অবহেলায় তার সন্তানের মৃত্যুর অভিযোগ করেন। হাতিরঝিল থানায় করা মামলায় হাসপাতালটির মালিক মুক্তাদিরসহ অবেদনবিদ মাহবুব ও অস্ত্রোপচার বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক আজাদকে আসামি করা হয়েছে। হাসপাতালের মালিক ডা. মুক্তাদির ও ডা. মাহবুবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত ডা. ইশতিয়াককে ধরতে অভিযান চলছে। জানা গেছে, ডা. মুক্তাদির জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারের মালিক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্থোপেডিক সার্জন; ডা. মাহবুব একই হাসপাতালের অবেদনবিদ (অ্যানেসথেসিওলজিস্ট) বিভাগের চিকিৎসক। আর ডা. ইশতিয়াক ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক।

দুই চিকিৎসককে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ : শিশু আয়হামের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার দুই চিকিৎসককে দুই দিন জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালত আসামির রিমান্ড ও জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে এ আদেশ দেন। আসামিরা হলেন জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মালিক ডা. এস এম মুক্তাদির ও ডা. মাহবুব মোরশেদ। এর আগে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার এসআই রুহুল আমিন আসামিদের আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। আসামিদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এর বিরোধিতা করা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড ও জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন। এর আগে ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় পাঁচ বছর নয় মাস বয়সী আয়ান আহমেদকে। সেখানে তাকে অস্ত্রোপচারের আগে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়। জ্ঞান না ফেরায় গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে এনে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। পরে ৭ জানুয়ারি রাত ১১টা ২০ মিনিটে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন। শিশুটিকে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করেন ডা. সাইদ সাব্বির আহম্মেদ। আর সার্জারি করেন ডা. তাসনুভা মাহজাবিন। এ ঘটনায় ৯ জানুয়ারি ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে বাড্ডা থানায় মামলা করেন আয়ানের বাবা মো. শামীম আহমেদ। ১৫ জানুয়ারি আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে কেন ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন হাই কোর্ট।

সর্বশেষ খবর