রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পুলিশ কেন অপরাধে জড়ায়

২০১৩-এর জানুয়ারি থেকে ২০২৩-এর অক্টোবর পর্যন্ত ১০ বছরে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৩৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সদর দফতর ও সংশ্লিষ্ট জায়গায় অভিযোগ জমা পড়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

গত শুক্রবার বিকাল ৩টা। রাজধানীর দোয়েল চত্বর এলাকায় বইমেলার দায়িত্ব পালন করছিলেন শাহজাহানপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ঠাকুর দাস মালো। দায়িত্ব পালনের চেয়ে যেন পুলিশের ক্ষমতা দেখানোর কাজেই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। যারাই তার অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিলেন, তাদের নানাভাবে নাজেহাল করেছেন। নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেছেন ক্ষমতাধর পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। তার সঙ্গে সরকারের ওপর মহলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলেও হুমকি-ধমকি দিচ্ছিলেন। সবশেষ ঠাকুর দাস মালোর আচরণের প্রতিবাদ করে রীতিমতো বিপাকে পড়েছিলেন একজন সিনিয়র সাংবাদিক। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহজাহানপুর থানা এলাকাতেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা অপরাধের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় রয়েছেন ঠাকুর দাস মালো। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ডিএমপি সদর দফতরে একাধিক লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এ বিষয়ে ঠাকুর দাস মালো এ প্রতিবেদকের কাছে এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি বলে দাবি করেন। তবে তার জানা মতে ডিএমপি সদর দফতরে একটি বেনামি অভিযোগের তদন্ত চলছে বলে স্বীকার করেন। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। কারণে অকারণে পুলিশের সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। উপরন্তু ঘাটে ঘাটে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। এতে করে দীর্ঘ প্রত্যাশিত জনগণের পুলিশ আজও হয়নি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঔপনেবিশক মনোভাবের কারণে জনগণের বন্ধু হতে পারছে না পুলিশ। সত্যিকার অর্থে একজন পুলিশ সদস্য দেশসেবার পাশাপাশি জনগণের প্রকৃত বন্ধু হওয়ার কথা থাকলেও সাধারণ মানুষ পুলিশের নাম শুনলে আঁতকে ওঠেন, ভয়ে তটস্থ থাকেন, পুলিশ ঝামেলা মনে করে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। নজরদারি এবং জবাবদিহিতার অভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা অনেক পুলিশ সদস্যই জড়িয়ে পড়ছেন নানা অপরাধে। তবে পুলিশ সদর দফতর বলছে, কোনো সদস্যের অপরাধের দায়ভার বাহিনী নেবে না। তদন্তসাপেক্ষে তাকে যথোপযুক্ত শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।

অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে, তা তদন্ত করা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধের ধরন অনুযায়ী ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হচ্ছে। অপরাধ গুরুতর না হলে লঘুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, ২০১৩-এর জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ বছরে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৩৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সদর দফতর ও সংশ্লিষ্ট জায়গায় অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ সদর দফতর অভিযোগ আমলে নিয়েই বিভিন্ন শাস্তি দিয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩ জনকে। ২০১৯ সালে ১৫ হাজার ৫১২ জন পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয়।

শাস্তি হয় ১৪ হাজার ৭১৭ জনের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৩১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে শাস্তি হয় ১৫ হাজার ২১২ জনের। ২০২১ সালে ১৬ হাজার ৮১৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে সদর দফতরে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৩১২ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০২২ সালে অভিযোগ বেড়ে ১৮ হাজার ৬১৮ হয়। যার মধ্যে শাস্তি হয় ১৭ হাজার ৫১৮ জনের এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯ হাজার ১৮ জন পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগে আসে। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৫২৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে আস্থার সংকটে আছে পুলিশ। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। এ অভিযোগ পুরনো হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর সত্যতা আছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে অপরাধের যে ধরন, অপরাধীদের পরিচয়, অর্থযোগ এবং পেশাগত ক্ষমতা, পোশাকের পরিচয় ব্যবহার করে কেউ কেউ অপরাধ করছে বা অপরাধীদের সহযোগিতা করছে। পুলিশ এই অভিযোগ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর জবাবদিহিতার বিকল্প নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর