রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
পিলখানা হত্যাকাণ্ড

বিচার শেষ হয়নি ১৫ বছরেও

আরাফাত মুন্না

আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি। ১৫ বছর এইদিনে পিলখানায় বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিদ্রোহ হয়। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে হঠাৎ গুলি ও বোমার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজধানী। সেদিন পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদর দফতর রক্তাক্ত করেন ওই বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। হত্যা করা হয় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। টানা দুই দিন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আসে। পিলখানা বিদ্রোহের পর বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়। পরিবর্তন করা হয় বাহিনীর লোগো এবং পতাকা।

এ বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার বিচার শেষ হয়নি এই ১৫ বছরেও। আসামির সংখ্যা ও মৃত্যুদণ্ডের দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ হত্যা মামলা বিচারিক আদালত ও হাই কোর্ট হয়ে এখন চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আপিল বিভাগে বিচারাধীন। অন্যদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাটি এখনো নিম্ন আদালতেই সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ১২৬৪ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে ২৭৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়। পুরান ঢাকার বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় দেন। ওই রায়ে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু (প্রয়াত), স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় রায়ে ২৭৭ জনকে খালাস দেন বিচারিক আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জন পলাতক। এ ছাড়া বন্দি অবস্থায় তোরাব আলীসহ দুই আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন। এ রায়ে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন হাই কোর্ট। খালাস পান ৪৯ আসামি। পরে ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি ১১ দফা পর্যবেক্ষণসহ হাই কোর্ট ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় (ডেথ রেফারেন্স ও আপিল নিষ্পত্তি করে) প্রকাশ করেন। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চের বিচারপতিরা বাংলা ও ইংরেজিতে দেওয়া রায়ে ভিন্ন পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ে মামলার প্রেক্ষাপট, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও নৃশংসতার চিত্রও তুলে ধরা হয়। হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০৩ আসামির পক্ষে ৪৮টি আপিল আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় দাখিল করা হয়। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পিলখানা হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত শুনানি করতে আপিল বিভাগে আলাদা বেঞ্চ গঠন করতে হবে। এ ছাড়া আপিল বিভাগে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত বিচারক নেই। আরও চারজন বিচারক প্রয়োজন। কয়েক হাজার পৃষ্ঠার আপিল উভয়পক্ষ শুনানি করতে টানা ৩০-৪০ দিন সময় লাগবে। আশা করছি শিগগিরই আপিল বিভাগে নতুন বিচারক নিয়োগের পর নতুন বেঞ্চ গঠন করে শুনানি শুরু হবে এ মামলার। আসামি পক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় হাই কোর্ট ও বিচারিক আদালতের রায়সহ যাবতীয় নথিপত্র আপিল বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। আপিলের সারসংক্ষেপও জমা দেওয়া হয়েছে, কোনো কিছুই বাকি নেই। যেভাবেই হোক ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে এবং আলাদা বেঞ্চ গঠন করে এ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। এদিকে হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দুটি ধাপ শেষ হলেও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলায় ১ হাজার ২৬৪ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৭৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ২৮-২৯ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে। আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে এ মামলার বিচার চলছে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার কারণে মামলার বিচারকাজ অনেক পিছিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ২৭৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এখন প্রতি মাসে দুই দিন বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে। এ বছর বিচার শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিচার হয়েছে নিজস্ব আইনেও : বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় এ বাহিনীর নিজস্ব আইনেও বিচার হয়। বিডিআর জওয়ানদের ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। এতে মোট ১১ হাজার ২৬৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তার মধ্যে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাকিরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ আদালত গঠন করে ৬ হাজার ৪৬ জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়। আর বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত ১১৫ জন পরে চাকরি ফিরে পান।

ফিরে দেখা : ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর দরবার হলে ৯৭ সেনা কর্মকর্তাসহ আড়াই হাজারের বেশি সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন সকালে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের পর বক্তব্য দেন তখনকার বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহম্মেদ। তার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ গুলি ও বোমার বিকট শব্দ হয়। এরপর সেখানে একে একে হত্যা করা হয় ডিজি শাকিল আহম্মেদসহ অনেক সেনা কর্মকর্তাকে। দুই দিন ধরে চলে বিপথগামী বিডিআর সদস্যদের তাণ্ডব। পরে সরকারের আহ্বানে তারা আত্মসমর্পণ করেন। অনেকে পালিয়ে যান। পলাতকদের মধ্যে কেউ কেউ পরে আত্মসমর্পণ করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর