বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
পুলিশ সপ্তাহ শুরু

পুলিশ জনগণের বন্ধু, এটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার : প্রধানমন্ত্রী

৪০০ পুলিশ সদস্য পেলেন বিপিএম-পিপিএম পদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুলিশ জনগণের বন্ধু, এটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন পদক পরিয়ে দেন -পিআইডি

সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারির সঙ্গে মানবীয় মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করতে পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু, এটা সব সময় হয়ে আসছে। এটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া একান্ত দরকার।

গতকাল সকালে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।

পুলিশ সপ্তাহ-২০২৪ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি পুলিশের বিভিন্ন কন্টিনজেন্ট ও পতাকাবাহী দলের নয়নাভিরাম, সুশৃঙ্খল ও দৃষ্টিনন্দন কুচকাওয়াজ পরিদর্শন এবং অভিবাদন গ্রহণ করেন। এরপর অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশ সদস্যদের মাঝে পদক প্রদান করেন। গতকাল শুরু হওয়া ছয় দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহের এবারের মূল প্রতিপাদ্য ‘স্মার্ট পুলিশ স্মার্ট দেশ, শান্তি প্রগতির বাংলাদেশ’। পুলিশ সপ্তাহের বার্ষিক কুচকাওয়াজে প্যারেড কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিসি মো. সোহেল রানা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন কন্টিনজেন্টের সদস্যরা কুচকাওয়াজে অংশ নেন। পুলিশ সপ্তাহ-২০২৪ শেষ হবে ৩ মার্চ। এবারের পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি, ২০২৪ পর্যন্ত অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ৩৫ পুলিশ সদস্যকে ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)’, ৬০ জনকে ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম)’ এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামলূক আচরণের মাধ্যমে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য ৯৫ পুলিশ সদস্যকে ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) সেবা’ এবং ২১০ জনকে ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) সেবা’ পদকে ভূষিত করা হয়। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষ যখনই কোনো বিপদে পড়ে, সবার আগে আশ্রয় খোঁজে পুলিশের। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পুলিশ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে জানিয়ে তিনি বলেন, করোনায় যখন আত্মীয়স্বজন পাশে ছিল না, তখনো পুলিশ ছিল মানুষের পাশে, মানুষের আশ্রয়স্থল। সে সময়ও মৃতদেহ দাফনকাফনের ব্যবস্থা করেছে তারা। পুলিশবাহিনীর প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিভিন্ন সময় পুলিশ জনগণের জানমাল রক্ষায় জীবন দিয়েছে। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজারবাগে ঢুকে ওই জামায়াত-বিএনপি হামলা করেছে। পুলিশ ধৈর্যের সঙ্গে এগুলো মোকাবিলা করেছে। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে গিয়েও আমাদের পুলিশবাহিনী বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। অনেকে জীবনও দিয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশবাহিনীর সদস্যদের বলব আপনারা দেশের মানুষের সেবা করুন। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন, এটি হচ্ছে পুলিশের মূলমন্ত্র। কাজেই পুলিশবাহিনী মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করবে-এটিই সব সময় আমাদের কাম্য।

১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রথম পুলিশ সপ্তাহে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে জাতির পিতা প্রদত্ত ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী তাদের জনগণের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আরও একনিষ্ঠ হয়ে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘তোমরা স্বাধীন দেশের পুলিশ। তোমরা ইংরেজের পুলিশ নও। তোমরা পাকিস্তানি শোষকদের পুলিশ নও। তোমরা জনগণের পুলিশ। তোমাদের কর্তব্য জনগণকে সেবা করা। বাংলার মানুষ চায় তারা শান্তিতে ঘুমাক। তোমাদের কাছ থেকে আশা করে যে, চোর, বদমাশ, গুন্ডা, দুর্নীতিবাজ তাদের ওপর অত্যাচার না করে। তোমাদের কর্তব্য অনেক বেশি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার ভাষণের এই মর্মবাণী ধারণ করে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য গভীর দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে কাজ করে যাবে, এই আমার প্রত্যাশা। তিনি বলেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় এবং সেই সময় যেমন পুলিশ জনগণের পাশে থাকে, আবার কভিড-১৯ অতিমারির সময়ও পুলিশবাহিনী বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ‘৩৩৩’ নম্বরে ফোন করলে রাতবিরাতে তারা মানুষের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। এমনকি ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করলে পুলিশ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তাদের সহযোগিতা করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য এই বাংলাদেশ আমরা দেখেছি সেই ২০১৩, ’১৪, ’১৫ সাল অথবা এই ’২৩ সালের ২৮ অক্টোবর কীভাবে অগ্নিসন্ত্রাস করে জাতীয় সম্পদগুলো নষ্ট করা এবং যানবাহনসহ বিভিন্ন অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হলো। চলন্ত বাস ও ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। তারা (জামায়াত-বিএনপি) যে শুধু এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাই নয়, পুলিশ যখন বাধা দিতে গেছে পুলিশের ওপর হামলা করেছে। নির্মমভাবে পিটিয়ে নিরীহ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। এমনকি রাজারবাগে ঢুকে ককটেল মারা, হাসপাতালে আক্রমণ করা, অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়ি পুড়িয়ে ফেলাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ওই জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা করেছে, তাদের নেতারা করেছে। তবে আমাদের পুলিশবাহিনী অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে এ অবস্থার মোকাবিলা করেছে। জনগণের জানমাল ও শান্তি রক্ষায় পুলিশ সদস্যরা তাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন এবং এই ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম রুখে দিয়েছেন। জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় পুলিশবাহিনীর সদস্যরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি শান্তি রক্ষায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে যেসব পুলিশ সদস্য জীবন দিয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।

‘তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা এবং পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে আজকে পুলিশবাহিনী অনেক বেশি দক্ষ’ উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, প্রতিনিয়ত আমরা যখন নতুন ধরনের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বা সাইবার ক্রাইমসহ বিভিন্ন কিছু দেখছি তার জন্য পুলিশকেও বহুমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে উপযুক্ত পুলিশবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার বিভিন্ন পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। যেমন ২০০১ সালে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের ব্যাপক উত্থানে জনজীবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। আমরা ২০০৯ সালে সরকারে আসার পর জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে অ্যান্টি টেররিজম পুলিশ ইউনিট (এটিইউ) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) গঠন করেছি। তিনি বলেন, তাঁর সরকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও দমনে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌপুলিশ, অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন, এমআরটি পুলিশ গঠন করা করেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তায় আর্মড পুলিশের দুটি এবং র‌্যাবের একটি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তদন্তের কাজ যাতে দ্রুত শেষ হয় এবং মানুষ ন্যায়বিচার পায় সেজন্য বাংলাদেশ পুলিশে ইতোমধ্যে ডিএনএ ল্যাব, আধুনিক ফরেনসিক ল্যাব, অটোমেটেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এএফআইএস) এবং আধুনিক রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে। কয়েকটি বিভাগীয় শহরে এসব ল্যাবের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পুলিশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আরও বলেন, সাইবার অপরাধ এবং এর সঙ্গে যুক্ত ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইম, মানি লন্ডারিং ইত্যাদি অপরাধ মোকাবিলায় ‘সাইবার পুলিশ সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিএমপির সিটিটিসিসহ পুলিশের অন্যান্য ইউনিটও সাইবার অপরাধ দমনে কাজ করছে। পুলিশে একটি পূর্ণাঙ্গ সাইবার ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে। ১০ তলা ভবন করে রাজারবাগে পুলিশ হাসপাতাল আধুনিকায়ন করা হয়েছে। পুলিশের জন্য উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যানবাহন সরবরাহ, পুলিশে একটি পূর্ণাঙ্গ এভিয়েশন ইউনিট গঠনের চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শিগগিরই দুটি হেলিকপ্টার যুক্ত করা, বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক সেবা ও মোবাইল অ্যাপস্ প্রবর্তন, অনলাইন জিডি, ই-ট্রাফিক প্রসিকিউশন এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য ই-সার্ভিস চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত কমিউনিটি ব্যাংকের মাধ্যমে পুলিশ ও সাধারণ মানুষ আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছে এবং পুলিশে শতভাগ রেশন চালু করা এবং অবসরপ্রাপ্ত সব পুলিশ সদস্যের আজীবন রেশন প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় পুলিশ সদস্যরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিশেষ অবদান রাখবেন-এ প্রত্যাশা রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই আমাদের পুলিশবাহিনী আরও দক্ষ, পেশাদার, যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানের একটি স্মার্ট সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। আর সে কারণেই আপনাদের প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট অত্যন্ত জরুরি এবং সে ব্যাপারেও আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর