শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

বেইলি রোডে ভয়াবহ আগুনে মৃত্যু ৪৪

আশঙ্কাজনক আরও অন্তত ১৫ জন স্বজনের কান্নায় ভারী গোটা এলাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেইলি রোডে ভয়াবহ আগুনে মৃত্যু ৪৪

আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস (বাঁয়ে), জ্বলছে গোটা ভবন (মাঝে), একজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে উদ্ধারকর্মীরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে আগুনে পুড়ে ও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে কমপক্ষে ২ নারী ও ৭ শিশুসহ অন্তত ৪৪ জন নিহত হয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন গতকাল দিবাগত রাত ২টার দিকে জানান এ ঘটনায় ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ঢাকা মেডিকেলে আহত, নিহতদের পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, আরও অন্তত ১৫ জন খুবই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। পরে রাত তিনটার দিকে আহত আরেকজনকে মৃত ঘোষণা করে ঢামেক কর্তৃপক্ষ। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান রাত ৯টা ৫০ মিনিটে আগুন লাগে এবং দুই ঘণ্টারও বেশি সময় চেষ্টার পর তা নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে উদ্ধারকারী দমকল বাহিনী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর বাচ্চু মিয়া জানান, রাত দেড়টা পর্যন্ত ৩১ জনের লাশ মর্গে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে নিহতের এই সংখ্যা আরও বাড়ে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে অজ্ঞান অবস্থায় ১৯ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়। এদের মধ্যে ৮ জন নারী ও দুই শিশুকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৩২ জনকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা আরেকজন রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে মারা গেছেন এবং রাত প্রায় ৩টার দিকে আরেকজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ৭৫ জনকে আহত অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানান, রাত ২টা পর্যন্ত অন্তত ৪৩ জনের লাশ এসেছে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল ও ঢামেকের মর্গে। তখনো কিছুক্ষণ পর পর লাশ আসছিল। নিহতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গতকাল রাত পৌনে ১০টায় ওই ভবনের বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্টে মানুষ যখন খাবার খাচ্ছিলেন ঠিক তখনই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপরেই আগুন ধরে যায়। সাত তলা ভবনের একটি ফ্লোরে থাকা কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা। আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেখানে। রেস্টুরেন্টে আসা শতাধিক মানুষ আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে। বাঁচাও বাঁচাও গগনবিদারী চিৎকারে সেখানে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভবনে আটকে পড়ে যায় খেতে আসা নারী-শিশুসহ নানা বয়সী লোকজন। আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট। আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিলেও উৎসুক জনতার কারণে তাদের চরম বেগ পেতে হয়। এতে উদ্ধার কাজ ও আগুন নেভানোর কাজও বাধাগ্রস্ত হয়। আগুন নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই ভবন থেকে ৭০ জনকে উদ্ধার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ, র‌্যাব ঘিরে রাখে ঘটনাস্থল। ৩ প্লাটুন বিজিবি ও আনসার মোতায়েন করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার এরশাদ হোসেন জানান, বেইলি রোডের কেএফসি ভবনের পাশে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের ভবনে আগুন লাগার খবর আসে রাত ৯টা ৫০ মিনিটে। খবর পেয়ে প্রথমে চার ইউনিট, পরে আরও চারটি ইউনিট পাঠানো হয়। এরপর আরও চারটি ইউনিট কাজ শুরু করে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে মোট ১৩টি ইউনিট। রাত পৌনে ১১টায় আগুন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসে। এর মধ্যেই একের পর এক আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে থাকে ফায়ার সার্ভিস। বিভিন্ন ফ্লোরে খাবার খেতে আসা মানুষের অনেকেই ছাদে গিয়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন। ফায়ার সার্ভিস মই দিয়ে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করে। ভিতরে আটকে থাকা অনেকেই ধোঁয়ার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। রাত ১২টা পর্যন্ত ওই ভবন থেকে ৭০ জনকে জীবিত উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। ওই ভবনের ছাদ থেকে উদ্ধার হওয়া এক ব্যক্তি জানান, ছাদে অনেক মানুষ আটকা আছে। এদিকে আগুনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ভবনটির সামনে ভিড় করতে শুরু করেন ভিতরে আটকে পড়াদের স্বজনরা। স্বজনদের খোঁজ না পেয়ে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। রাস্তায় বহু মানুষ তাদের আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ নিতে আসেন। এতে ঘটনাস্থল ও এর আশপাশের এলাকায় হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। অনেককে নিখোঁজ স্বজনদের ছবি নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে।

বার্ন ইনস্টিটিউটের অবস্থা : আগুনে আহত ও পোড়াদের শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। রাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি তিনি সমবেদনা জানান। একই সঙ্গে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা ১৫ জন ও আহতের সুচিকিৎসার নির্দেশনা দেন। এ ঘটনায় রাত ২টা পর্যন্ত সবমিলিয়ে মারা গেছেন অন্তত ৪৩ জন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা : প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ভবনটিতে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট ছাড়াও স্যামসাংয়ের শোরুম, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার, ইলিন, খানাস ও পিৎজা ইন রয়েছে। আগুন লাগার পর ছয় তলা ওই ভবনের ভিতরে বেশ কয়েকজন আটকা পড়েন। ভবন থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে অনেকে আহত হন। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আহতদের উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। তারা জানান, আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় পুরো ভবন ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায় এবং দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। আটকে পড়াদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা কাজ করলেও ক্রমেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আটকে পড়াদের মধ্যে রয়েছেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে রাত ১১টার দিকে লিখেছেন, আমরা এখনো মারা যাইনি, ছাদে আছি। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন ইনশা আল্লাহ। কল নয়, দোয়া করুন। আহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন- বাবুর্চি দীন ইসলাম (২৮), সহকারী জুয়েল (৩০), জোবায়ের (২০), ওয়েটার আরিফ (২০), ইকবাল (৩৫), উজ্জ্বল সর্দার (২৩), রাকিব (২৫), শাকিল (২২), ওমর ফারুক (৪৩), সিজান (২৫), রাসেল (৩৫), ইমরানসহ (১৪) ১২ জন। আহতদের সূত্রে জানা গেছে, সেখানে কাচ্চি ভাইসহ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। উদ্ধারকৃতদের অধিকাংশই ওইসব রেস্টুরেন্টের কর্মচারী।

আগুনের সূত্রপাত চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে : গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লেগে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। ভবনটির প্রতিটি ফ্লোরেই গ্যাসের সিলিন্ডার ছিল বলেও জানিয়েছেন বাহিনীটির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়া জেনারেল মঈন উদ্দিন।

সর্বশেষ খবর