শনিবার, ২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আগুনে স্বপ্ন পুড়ে ছাই

মির্জা মেহেদী তমাল

আগুনে স্বপ্ন পুড়ে ছাই

ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন, স্ত্রী স্বপ্না বেগম একমাত্র ছেলে আবদুল্লাহ, দুই মেয়ে কাশফিয়া ও নূর

♦ ইতালি যাওয়া হলো না, আগুনে শেষ পুরো পরিবার
♦ বেইলি রোডে আগুনে মারা গেলেন সাংবাদিক অভিশ্রুতি
♦ কনভোকেশনে অংশ নেওয়া হলো না তুষারের
♦ মায়ের মৃত্যুর পর বাবা-বোনকে আগলে রাখা লামিশার প্রাণ গেল আগুনে
♦ মর্গে সাগরের লাশ বাইরে স্বজনদের অপেক্ষা
♦ বুয়েটের নাহিয়ানই ছিল দরিদ্র পরিবারের একমাত্র আশা
♦ সন্তান ও স্বজনদের বাঁচিয়ে মারা গেলেন তানজিলা নিজেই
♦ পরিচয় মিলল সেই পরীর, মর্গে মা বাবাও
♦ শপিং করতে গিয়ে এক সঙ্গে ৩ বোনের মৃত্যু

 

ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউছারের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইতালি যাবেন। বাকিটা জীবন কাটাবেন তারা সেখানেই। তার সেই স্বপ্ন পূরণও হতে যাচ্ছিল। আগামী মাসেই তাদের ইতালি যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল। শেষ গোছগাছ চলছিল তাদের। কিন্তু বেইলি রোডের সেই ভয়াবহ আগুনে তাদের সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাদের বিদেশ যাওয়া হলো না। পাঁচজনের পুরো পরিবারের ঠিকানা হলো না ফেরার দেশে।

গতরাতেই রিয়ার মালয়েশিয়া যাওয়ার ফ্লাইট ছিল। আগের দিন গেল শপিং করতে ও তাদের এক আন্টির সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে গিয়ে আর ফেরেনি। রিয়ার সঙ্গে ছিল ছোট বোন আলিশা এবং তাদের এক খালাতো বোন নিমু। তিনজনই কেনাকাটা করে গিয়েছিল কাচ্চি ভাইতে। তিনজনই এখন আর বেঁচে নেই। রিয়া আর আলিশার লাশ ধরে কাঁদছিলেন তাদের বাবা কোরবান আলী। বলছিলেন, আমার সব স্বপ্ন শেষ। মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিল রিয়া। এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাহিয়ান আমিন। বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী যন্ত্রকৌশল বিভাগের ২২ ব্যাচের লামিশা ইসলাম। দুই বন্ধু গিয়েছিল কাচ্চি ভাইতে। তারা আর ফিরে আসেনি। তাদের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে ভয়ংকর আগুনে। শুধু এ কজনের স্বপ্নই নয়, স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়েছে তাদের মতো আরও অনেকের। বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের সাত তলা ভবনের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে রেস্টুরেন্ট। আর দুই ঘণ্টার আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে অসংখ্য মানুষের স্বপ্ন। উচ্চমাধ্যমিকের লেখাপড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল নুসরাতের। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে ফোনে বলেছিল, ‘আব্বু, আগুন! আমাদের বাঁচান।’ নুসরাতকে কেউ বাঁচাতে পারেনি। বড় সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন অভিশ্রুতি। জীবনের শুরুতেই শেষ হয়ে গেল সব। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আর বোনকে আগলে রাখা লামিসাও চলে গেলেন আগুনে। বুয়েট শিক্ষার্থী লামিসার স্বপ্ন ছিল, অনেক বড় প্রকৌশলী হবেন। বুয়েটের অপর শিক্ষার্থী নাহিয়ান ছিলেন পরিবারের একমাত্র আশা।

সেদিন ছিল সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার, তার ওপর অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার! খাবারের সঙ্গে বেশ আড্ডা জমেছিল বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টগুলোতে। এ দিনটিকে উদযাপন করতে অনেকেই রেস্টুরেন্টে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। কাচ্চি ভাইতে ছিল বিশেষ ছাড়। যে কারণে অন্যান্য দিনের চেয়ে সেই সন্ধ্যায় ভিড় ছিল একটু বেশি। রাত পোনে ১০টার ভয়ংকর আগুনে সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে। ঝলমলে রেস্টুুরেন্টটি হয়ে ওঠে তখন মৃত্যুকূপ। হুড়োহুড়ি ছোটাছুটিও কেউ করতে পারছিল না। আগুনকেই যেন নারী পুরুষ ও শিশুরা আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়েছিল। রেস্টুরেন্টের সব সিঁড়ি ছিল আটকা। আর তাতেই আটকে যায় সবাই। একে একে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। এক সময়ে জানা যায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এই মৃত্যুতে পরিবারগুলো শুধু প্রিয় স্বজনকেই হারালো না, তাদের আশা-আকাক্সক্ষারও মৃত্যু ঘটল।

রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউছারসহ তার পরিবারের নিহত পাঁচজনের জানাজা গতকাল বাদ আসর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের শাহবাজপুর ইউনিয়নের খন্দকারপাড়ায় অনুষ্ঠিত হয়  -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ইতালি যাওয়া হলো না মোবারকের : ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউছারের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইতালিতে সেটেলড হওয়ার। অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণও হতে চলেছিল। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়ে ফাতেমা তুজ জোহরা কাশফিয়া ও আমেনা আক্তার নূর, আট বছর বয়সী ছেলে সৈয়দ আবদুল্লাহ ও তার স্ত্রী স্বপ্না আক্তারের জন্য ভিসা পেয়েছিলেন। আগামী ১৮ মার্চ পুরো পরিবার নিয়ে তাদের ইতালির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। সেই আনন্দ উদযাপন করতেই বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন পরিবারটি। রাতের অগ্নিকাণ্ডে তারা রক্ষা পাননি। ইতালি প্রবাসী কাউছার ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের কেউ বাঁচতে পারেননি। একে একে আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেন সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউছার, তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম, দুই মেয়ে সৈয়দা নূর, সৈয়দা কাশফিয়া ও একমাত্র ছেলে সৈয়দ আবদুল্লাহ। মোবারক হোসেনের পরিবারের নির্মম মৃত্যুর সংবাদে শোকে কাতর হয়ে পড়েছে গোটা ইউনিয়ন। পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শাহবাজপুর খন্দকার পাড়ার প্রয়াত সৈয়দ আবুল কাশেমের ছেলে সৈয়দ মোবারক হোসেন। এলাকায় তিনি সবার কাছে কাউছার নামেই পরিচিত ছিলেন। কাউছার ইতালিতে ব্যবসা করতেন। তার পরিবার ঢাকার মধুবাগে বসবাস করত।

লামিশা

অতিরিক্ত ডিআইজির কন্যাসহ বুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু : রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে লামিসা ইসলাম ও নাহিয়ান আমিন নামে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। লামিসা ইসলাম বুয়েটের মেকানিক্যাল বিভাগের শিক্ষার্থী ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি মো. নাসিরুল ইসলামের মেয়ে। আর নাহিয়ান আমিন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। লামিসার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে এবং নাহিয়ানের বাড়ি বরিশালে বলে জানা গেছে। স্বজনরা জানান, বুয়েটের বন্ধু নাহিয়ান আমিনের সঙ্গে ওই ভবনের একটি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন লামিসা। আগুনে দুজনই মারা গেছেন। নাহিয়ান ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র আশা-ভরসা।

দুই মেয়েকে হারিয়ে শোকে পাথর দুদক কর্মকর্তা : রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের ঘটনায় একসঙ্গে দুই মেয়েকে হারিয়েছেন দুদকের সহকারী পরিদর্শক কবির হোসেন জুয়েল। এ ঘটনায় শোকে পাথর হয়ে পড়েছেন তিনি। মেয়েদের জন্য তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া দুই মেয়ে হলেন মেহেরা কবির দোলা (২৯) ও মাইশা কবির মাহী (২১)। বড় মেয়ে মেহেরা কবির দোলার কিছুদিন আগে বিয়ে হয়। তিনি আইএফআইসি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। আর ছোট মেয়ে মাহী স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্সের দ্বিতীয় সেমিস্টারে অধ্যয়নরত ছিলেন বলে জানা গেছে। কবির হোসেন জুয়েল রাজধানীর সরকারি এজিবি কলোনিতে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতেন। তিন মেয়ের মধ্যে মারা যাওয়া দুই মেয়ে বড় সন্তান। মর্মান্তিক এমন মৃত্যুর ঘটনায় দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ শোক প্রকাশ করেছেন।

আগুনে পুড়ে অঙ্গার মিনহাজ : বেইলি রোডের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া কে এম মিনহাজ উদ্দিনকে (২৫) চেনা যাচ্ছিল না। লাশে থাকা হাতঘড়ি দেখে স্বজনরা তাকে চিনতে পেরেছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি রাজধানীতে একটি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার প্রকৌশলী ছিলেন। চাঁদপুর সদর উপজেলার ইসলামপুরের ওয়ালিউল্লাহ খানের ছেলে মিনহাজ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারের কর্মস্থল থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন মিনহাজ। পরে এক বন্ধুর কাছ থেকে তারা জানতে পারেন, বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন মিনহাজ। গতকাল সকালে মিনহাজের লাশ ঢামেক হাসপাতালে শনাক্ত করে পরিবার। এ সময় মিনহাজের বড় ভাই আমিনুল ইসলাম কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, তার মা-বাবা চাঁদপুরের গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে মিনহাজ সবার ছোট ছিল। সে আমার সঙ্গে রাজধানীর বাসাবোতে থাকত। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল।

লুৎফুন নাহার ও মেয়ে জান্নাতি তাজরিন

ভিকারুননিসার শিক্ষক ও তার মেয়ের মৃত্যু : আগুনে মারা গেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাতি শাখার শিক্ষক লুৎফুন নাহার লাকি ও তার মেয়ে নিকিতা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিহত স্ত্রী ও মেয়ের লাশ শনাক্ত করেন গোলাম মহিউদ্দিন।

একসঙ্গে তিন বোনের মৃত্যু : গতকাল রিয়ার মালয়েশিয়া যাওয়ার ফ্লাইট ছিল। আগের দিন গেল শপিং করতে ও তাদের এক আন্টির সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে গিয়ে আর ফেরেনি আমার দুই মা। যাওয়ার আগে বলেছিল, বাবা আমরা তাড়াতাড়ি ফিরব।’ এ কথা বলে কেঁদে ওঠেন বাবা কোরবান আলী।

জানা গেছে, বেইলি রোডের বহুতল ভবনে লাগা আগুনে মারা যাওয়া ৪৬ জনের মধ্যে দুজন হলেন রিয়া ও আলিশা। তারা কুমিল্লার লালমাই উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের চরবাড়িয়া এলাকার হাজী কোরবান আলীর মেয়ে। ফৌজিয়া আফরিন রিয়া মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। আর সাদিয়া আফরিন আলিশা ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। একই ঘটনায় মারা গেছে তাদের খালাত বোন নুসরাত জাহান নিমু। তিনি সদর উপজেলার হাতিগড়া এলাকার আবদুল কুদ্দুসের মেয়ে ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী। তারা একই সঙ্গে শপিং করতে গিয়েছিলেন। ফাঁকে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে খেতে ঢোকেন।

বাঁচতে পারেন নাই এশা : ছয় বছরের ছেলে আরহাম, ভাইয়ের স্ত্রী লামিয়া তাবাসসুম এবং তার দুই মেয়ে আয়রা ও নাবাকে নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্টে খেতে যান তানজিলা এশা। নিচে আগুন লাগার খবর পেয়ে কাচ্চি ভাইয়ের জানালা ভেঙে নিজের ছেলে ও খালাত ভাইয়ের স্ত্রী সন্তানদের আগুন থেকে বের করে দিতে পারলেও, নিজে আর বের হতে পারেননি। বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুন মারা যান তিনি। রাতেই তানজিলা এশার খালাত ভাই তৌকির মুজিব ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট থেকে লাশ শনাক্ত করেন। নিহত তানজিলা এশা (৩০) পিরোজপুরের নড়াইল পাড়া এলাকার নাদিম আহমেদের স্ত্রী ও পিরোজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সালমা রহমান হ্যাপির ভাগ্নি। তানজিলা এশার খালাত ভাই তাহসান আহমেদ শাহিল জানান, বৃস্পতিবার রাতে কাচ্চি ভাইয়ে খেতে যান তানজিলা তিশা। সঙ্গে ছিল তার ছয় বছরের ছেলে আরহাম। এ সময় তার সঙ্গে আরও ছিলেন খালাত ভাই তানভীর মুজিবের স্ত্রী লামিয়া তাবাসসুম ও তার দুই মেয়ে আয়রা ও নাবা। তিনি আগুন থেকে সবাইকে বাঁচাতে পারলেও বাঁচাতে পারেননি নিজেকে। নিহত এশাকে শুক্রবার জানাজা শেষে পিরোজপুর পৌর গোরস্তানে দাফন করা হয়।

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্বজনের আহাজারিতে গতকাল ঢাকা মেডিকেলের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে   -বাংলাদেশ প্রতিদিন

খবর পাই আমার পরান পাখি নাই : আমার সোনা (নিহত কামরুল হাবিব রকি) প্রথমে আমার ভাইরে ফোন করে বলে যে ‘মামা আমারে বাঁচাও’। এরপর আমি আমার ফোন দিয়ে আমার সোনারে ফোন দিই, তখন আমার সোনা বলে, ‘আম্মা আমি মনে হয় আর বাঁচব না’। তখন আমি আমার সোনারে কলমা পড়তি বলি, আমিও কলমা পড়ছি, আমার সোনাও আমার সঙ্গে কলমা, দোয়া-দরুদ পড়ছে। কলমা পড়তি পড়তিই কল কেটে যায়, তারপর থেকে আর আমার সোনারে ফোন দিয়ে পাইনি, পরে খবর পাই আমার পরান পাখি আর নেই। খাটিয়ার পাশে বসে আহাজারি করতে করতে এভাবেই কামরুল হাবিব রকির মৃত্যুর শেষ সময়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তার মা রিপা বেগম। বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে লাগা আগুনের ঘটনায় সাত তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকানের ক্যাশিয়ার ছিল কামরুল হাবিব রকি। তিনি যশোর সদর উপজেলার ধোপাখোলা গ্রামের কবির হোসেনের ছেলে।

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী

মারা গেছেন সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রী : বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান দ্য রিপোর্টের একজন সাংবাদিক। তার নাম অভিশ্রুতি। একই প্রতিষ্ঠানের আরও একজন মারা যান। তার নাম তুষার হাওলাদার। সর্বশেষ স্টার টেক নামে একটি আইটি কোম্পানিতে ভিডিও জার্নালিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তুষার হাওলাদার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) সদ্য স্নাতক পাস করেছেন। আর অভিশ্রুতি রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।

পরিচয় মিলল সেই পরীর, মর্গে মা-বাবাও : রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবন গ্রিন কোজিতে আগুনের ঘটনায় মারা যাওয়া সেই শিশুর পরিচয় জানা গেছে। তার নাম ফাইরোজ কাশেম। শিশুটির বয়স আড়াই বছর। বাবার নাম শাহজালাল উদ্দিন। মা মেহেরুন নেসা জাহান হেলালী। শিশুটির বাবা-মাও আগুনে মারা গেছেন। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ফাইরোজ কাশেমের মা মেহেরুন নেসা জাহান হেলালীর বয়স (২৪)। বাবা শাহজালাল উদ্দিনের বয়স (৩৫)। মেহেরুন নেসা জাহান হেলালীর বাবার নাম মো. মুক্তার আলম হেলালী। শাহজালাল উদ্দিনের (৩৫) বাবার নাম ডা. আবুল কাশেম, মা রাজিয়া বেগম। তার বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়ার পূর্ব গোমালিয়ায়। শুক্রবার রাত ১০টায় মেহেরুন নেসা জাহান হেলালীর বাবা মুক্তার আলম হেলালী মৃতদেহ শনাক্ত করেন। ডিএনএ পরীক্ষার পর অন্য দুজনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

ফিলিপাইনের নাগরিক মা-মেয়ে নিহত : রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনের অগ্নিকাণ্ডে হবিগঞ্জের বাসিন্দা ও ফিলিপাইনের নাগরিক মা-মেয়ে নিহত হয়েছেন। হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা গতকাল রাতে গণমাধ্যমকে এই তথ্য জানান। নিহতরা হলেন- হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় বানেশ্বরপুর গ্রামের পোল্যান্ড প্রবাসী উত্তম কুমার রায়ের স্ত্রী রুবি রায় (৪০) ও মেয়ে প্রিয়াংকা রায় (১৭)। নিহত রুবি ফিলিপাইনের নাগরিক। প্রায় ২৮ বছর আগে বাংলাদেশি নাগরিক উত্তম কুমারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। নিহতদের পরিবারের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে বেইলি রোডে ‘কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁ’ থেকে খাবার আনতে যান মা রুবি ও মেয়ে প্রিয়াংকা। এ সময় সেখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মা-মেয়ে নিহত হন। নিহত প্রিয়াংকার বড় চাচা বিষ্ণু রায় বলেন, উত্তম ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় সেখানে ফিলিপাইনের নাগরিক রুবি রায়কে বিয়ে করেন।

পরবর্তী সময়ে উত্তম পোল্যান্ড যান। এ সময় তিনি স্ত্রী-কন্যাকে দেশে রেখে গিয়েছিলেন। মা-মেয়ে রাজধানীর মালিবাগে থাকতেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে উত্তম রায় পোল্যান্ড থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের মেঝেতে তাদের মৃতদেহ নাম-পরিচয়হীন ছিল। বুকে ঝোলানো কাগজে লেখা ছিল অজ্ঞাতনামা। মর্গে ফাইরোজ কাশেমের পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছিল তাদের। প্রায় ৪০ বছর বয়সী ওই নারীর দেহ গ্রামীণ চেকের চাদরে ঢাকা থাকলেও শিশুদেহ খোলা ছিল। ওই নারীর পরনে রয়েছে লাল জামা ও হলুদ সালোয়ার-কামিজ। শিশুটি বাম পায়ের মোজা আধখোলা। ঝুঁঁটি বাঁধা রয়েছে নীল রাবার ব্যান্ডে। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, কেউ তাদের মৃতদেহ নিতে আসেনি। দাবিও জানায়নি। তাদের চেহারায় মিল আছে। অনুমান করছি তারা মা-মেয়ে। মর্গে আসা স্বজন ও সাধারণ মানুষ শিশুটির মৃতদেহ দেখে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। শিশুটির ডান হাতে ছাইয়ের দাগ রয়েছে। তবে শরীরের কোনো অংশ পোড়েনি। ধারণা করা হচ্ছে, ধোঁয়ায় আটকে পড়ে অক্সিজেন স্বল্পতায় শিশুটি মারা গেছে। পাশে থাকা নারীর মৃতদেহও পোড়েনি। তার মুখমণ্ডলে ছাইয়ের দাগ রয়েছে। তাদের মৃতদেহ গ্রিন কোজির কত তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তা জানা যায়নি।

‘চুমুক’ থেকেই আগুন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর