রবিবার, ৩ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
মুস্তাফা খালিদ পলাশ

সুউচ্চ ভবনে বোঝাই করে রেস্টুরেন্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে

জিন্নাতুন নূর

সুউচ্চ ভবনে বোঝাই করে রেস্টুরেন্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে

ঢাকায় ঘটে যাওয়া সুউচ্চ ভবনগুলোর দুর্ঘটনাগুলোর ধরন লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ অগ্নিদগ্ধ হওয়ার চেয়ে শ্বাসরোধ হয়েই বেশি মৃত্যুবরণ করছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, তারা সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারছেন না। কেন পারছেন না? কারণ সিঁড়িগুলো যেভাবে অগ্নিনিরোধক হওয়ার কথা, তা করা হচ্ছে না। যেভাবে সিঁড়িগুলো ফায়ার রেটেড দরজা দিয়ে বন্ধ রাখার কথা, তা করা হচ্ছে না। আমাদের বুঝতে হবে আগুন কোনো জ্বালানি ছাড়া অগ্রসর হতে পারে না কিন্তু ধোঁয়ার সেটা প্রয়োজন পরে না। ফলে উত্তপ্ত ধোঁয়া প্রকৃতিগতভাবেই ঊর্ধ্বমুখী হয়ে অন্য তলায় চলে আসে। কীভাবে আসে? সেই উন্মুক্ত সিঁড়ির মাধ্যমে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক অগ্নিদুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আরও বলেন, সুউচ্চ ভবনে বোঝাই করে রেস্টুরেন্ট দেওয়া থেকে ভবন মালিকদের বিরত থাকতে হবে। আর এমন কিছু করা হলেও জনগণের এ ধরনের ভবন এড়িয়ে চলা উচিত। বরেণ্য স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। এই স্থপতি বলেন, আমরা দেখেছি, যেসব ভবনে ব্যবহারে ব্যত্যয় ঘটছে সেখানেই বেশি আগুন লেগেছে। কোনো একটি ভবন যেখানে বেশির ভাগ ফ্লোর অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেখানে একটি বা দুটি কফিশপ বা রেস্তোরাঁ ভবনটির ব্যবহারকারীদের জন্য থাকতেই পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একেবারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে বলবেন যে, একটি বাণিজ্যিক ভবনে নির্দিষ্ট করে দেওয়া অংশের চেয়ে বেশি রেস্টুরেন্ট থাকতে পারবে না। তিনি বলেন, আমরা আধুনিক হচ্ছি। আমাদের সব দিক দিয়ে উন্নয়ন ও অগ্রগতি হচ্ছে। এর সঙ্গে আমাদের ভবনগুলোও উন্নত ও সুউচ্চ হচ্ছে। কিন্তু এসব ভবনের যে ব্যবহারকারী, তাদের মধ্যে সচেতনতারও অভাব আছে। ভবন তৈরির জন্য আমরা স্থপতিরা নকশায় অনেক কিছু দিয়ে দিই কিন্তু ভবন তৈরির সময় তা মানা হলেও পরবর্তীতে স্থপতির অলক্ষে পরিবর্তন ঘটানো হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক স্থপতিরা তাদের জোর খাটাতেও পারেন না। আর না পেরে তারা সেখানে সারেন্ডার করতে বা সেই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। মুস্তাফা খালিদ পলাশ বলেন, আমার নকশায় করা সাতমসজিদ রোডে অবস্থিত ভবনের ব্যাপারে আমি খুব দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে, প্রতিটি ভবন আমরা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং বহির্গমন পথগুলো ঠিক করেই করার চেষ্টা করি এবং তা নজরদারি করি ভবনটি নির্মাণ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না তা যাচাই করতে ফায়ার ড্রিল বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ড আপৎকালীন ব্যবহারকারীদের কী কী করতে হবে, কোন পথ দিয়ে বের হতে হবে এসব জানার সুযোগ হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এই চর্চা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই বললেই চলে। এখানে কিছু করপোরেট হাউস ছাড়া কেউই এর প্র্যাকটিস করেন না। কিন্তু এটি করতে হবে। তাহলে ভবনের ব্যবহারকারীরা সচেতন হবেন। আবার অনেক ভবন মালিক আছেন, যারা নিজেদের ভবনে কখনো আগুন লাগবে না এমন চিন্তা থেকে অগ্নিনির্বাপণের জন্য তাদের ভবনে কোনো খরচ করতে চান না। ভবন মালিকরা অনেকেই ভবন নির্মাণের সময় এসব বিষয় এড়িয়ে যান। তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে আইনের ফাঁক আছে। ভবনগুলোতে একটি জেনারেল সিঁড়ি এবং আরেকটি ফায়ারের এক্সিট থাকার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দুটিকেই ফায়ার এক্সিট করতে হবে। দুটোই বিকল্প বহির্গমন পথ হতে হবে। এর মানে হচ্ছে সিঁড়ি বা করিডোর হোক তার যমজ বিকল্প পথ থাকতে হবে। আর এমনটি একতলা ভবনের ক্ষেত্রেও রাখা উচিত। তবে আমাদের বেশির ভাগ ভবনেই এটি মানা হয় না। সিঁড়িঘরটি খোলা ছিল বলেই বেইলি রোডের ভবনটির সিঁড়ি কেউ ব্যবহার করতে পারেনি। বরং ধোঁয়া এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেছে। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে সুউচ্চ ভবনে সিঁড়ি কোনোভাবে খোলা রাখা যাবে না। মুস্তাফা খালিদ পলাশ বলেন, আমাদের জীবনব্যবস্থায় ‘সোর্স অব ফায়ার’ এখন অনেক বেড়ে গেছে। সাধারণ শর্টসার্কিট ও রান্নাঘর থেকে আগুন লাগতে পারে। বিশেষ করে ইলেকট্রিক্যাল আগুনের সূত্র আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। বেইলি রোডের ভবনটিতে নিচ তলার সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে বলেই দুর্ঘটনাটি এত ভয়াবহ হয়েছে। ওপরে হলে হয়তো নিচের ফ্লোরগুলোয় আগুন এভাবে ছড়াত না। এই স্থপতির মতে, আমাদে ব্যবহারকারীদের এসব দুর্ঘটনা রোধে প্রথম সচেতন হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে, তিনি যেখানে আছেন তা নিরাপদ কি না। আমরা একটি ভবন সুন্দর দেখলেই সেখানে বিনোদনের জন্য চলে গেলাম কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে দৃষ্টিনন্দন ভবন কখনোই জীবনের চেয়ে বড় হতে পারে না। এখানে নিরাপত্তাই প্রথমে আসতে হবে। সাতমসজিদ রোডের দৃষ্টিনন্দন অফিস ভবন যেটি তার নকশায় করা হয়েছে এবং যেটি তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন সেই ভবনটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি অনেকদিন ধরেই এ ভবনের ডেভেলপার/ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং জমির মালিকদের এর নিরাপত্তা নিয়ে যে সমস্যা আছে তা বলে আসছি। তাদের জানিয়েছি যে, এ ভবনে এতগুলো রেস্টুরেন্ট কোনোভাবেই দেওয়া উচিত না। তাদের ফায়ার লাইসেন্স এবং অকুপেন্সি সনদ নেওয়ার কথা বলেছি, বলেছি ভবনটি একটি ভয়াবহ টাইম বোমায় পরিণত হয়েছে। এতকিছু বলার পরও ভবনটির ডেভেলপার আমাকে জানিয়েছেন, এর লাইন্সেস আছে। কিন্তু আমার বধ্যমূল ধারণা, এটি প্রাক অনুমোদন ছাড়পত্র, ফায়ার লাইসেন্স নয়। এটি রাজউকের ভবন অনুমোদনের পূর্বশর্ত। যদিও ভবনটি অনুমোদিত নকশার আলোকে নির্মাণ করা হয় কিন্তু এটি বানানোর পরই এর ব্যবহারের ক্রমান্বয় পরিবর্তন ঘটানো হয় এবং এর যথেচ্ছচার এবিউজ শুরু হয়; ফায়ার এক্সিটের দরজা খুলে ফেলা, মানুষকে ফায়ার এক্সিট ব্যবহার করতে না দেওয়া, ফায়ার এক্সিটের মধ্যে স্টোরেজ করা, সেখানে সিলিন্ডার রাখা- এ ধরনের কাজগুলো ভবনটির ব্যবহারকারীরা ক্রমান্বয়ে করছিলেন। আমি যত দূর শুনেছি, সেই ভবনটিতে লিফট ছাড়া কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করতে পারত না। যদি কোনো কারণে সেখানে আগুন লাগে, তাহলে সেখান থেকে কীভাবে মানুষ নামবে! অথচ ভবনটিতে দুটি ফায়ার এক্সিট বা ফায়ার স্টেয়ার আছে এবং দুটোই ফায়ার রেটেড। কী ভয়াবহ অনাচার! ভবনটির জন্য অকুপেন্সি সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করতে হলে আমাকে সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখতে হয় কিন্তু সেই সুযোগ আমার হয়নি। এর আগেই তারা ভবনটির ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন। ভবনটির ব্যবহারকারীসহ আমাদের স্থপতিরা যখন এর নানা সমস্যা নিয়ে আমাকে জানায়, আমি তখন ভবনটির ডেভেলপার কোম্পানিকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিখেছিলাম যে, ভবনটি ব্যবহারের আগে তার ফায়ার লাইন্সেস এবং অকুপেন্সি সার্টিফিকেট লাগবে।

তারা উত্তরে আমাকে জানান যে, তাদের ফায়ার লাইন্সেস আছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কোনোভাবেই এ ভবনের জন্য ফায়ার লাইন্সেস দেওয়ার কথা না। যাই হোক আমি বেইলি রোডের ভবনটির দুর্ঘটনার কারণে আবেগতাড়িত হয়ে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মানুষকে সচেতন করতে আমার নকশা করা ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের একই রকম আরেকটি ভবন নিয়ে আমার ফেসবুক আইডিতে বলেছি যে, এই ভবনটিও নিরাপদ নয়। মানুষের এই ভবনটিতে না যাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করছি। বেইলি রোডের ভবনটির চেয়েও ধানমন্ডির ভবটি আরও বড়, যা কি না ১৪ তলা। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে সাতমসজিদ রোডের ভবনটির একজন মালিক আমার কাছে করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমি সোজাসাপ্টা তাকে জানিয়েছি, প্রথমেই ভবনটি থেকে তাদের সব রেস্টুরেন্ট সরাতে হবে। এরই মধ্যে ফায়ার ডিপার্র্টমেন্ট সেখানে চিঠি দিয়েছে, জানতে পেরেছি। তবে খালি চিঠি দিলেই হবে না। এজন্য সংশ্লিষ্টদের শক্ত ভূমিকায় যেতে হবে। যদি এরপরও তারা কথা না শোনে, তাহলে ভবনটির বিদ্যুৎ এবং পানির সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে শক্তভাবে বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ না করলে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না।

সর্বশেষ খবর