শিরোনাম
সোমবার, ৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

রেস্টুরেন্ট ভবন যখন টাইমবোমা

♦ ধানমন্ডি মিরপুর খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনজুড়ে রেস্টুরেন্টের ছড়াছড়ি ♦ নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, যত্রতত্র সিলিন্ডার ♦ সংকুচিত সিঁড়ি, ছোট লিফট, নেই বিকল্প বহির্গমন পথ

জিন্নাতুন নূর

রেস্টুরেন্ট ভবন যখন টাইমবোমা

ধানমন্ডিতে এরকম বহুতল অসংখ্য ভবনে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট ছবি : রোহেত রাজীব

ঢাকায় ‘রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং’ এখন নতুন ট্রেন্ড। রাজধানীর বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকায়ও ভবন নির্মাণের নিয়ম-কানুন না মেনেই একের পর এক তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ও আলো ঝলমলে এক একটি রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং। যেখানে নামিদামি সব রে¯েঁÍারা দেদার ব্যবসা করছে। রাজধানীবাসীর বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় এখন বেশির ভাগই পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসব বিল্ডিংয়ে খেতে যান। কিন্তু এসব ভবনের বেশির ভাগেরই নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, বিকল্প সিঁড়ি, ফায়ার এক্সিট, খোলা জায়গা। ভবনগুলোতে যে লিফট ব্যবহার করা হয় তা খুবই সংকীর্ণ এবং কিছু ভবনে ওপরে ওঠার জন্য একমাত্র যে সিঁড়ি ব্যবহার করা হয় সেটিও খুব ছোট। এসব সিঁড়িতে এবং রেস্টুরেন্টের সামনে যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার রেখে দেয় রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞরা এসব ভবনকে বলছেন এক একটি টাইমবোমা। তাদের মতে- এসব ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী। এখানে যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে বিশাল দুর্ঘটনা। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে রয়েছে এ ধরনের অসংখ্য সুউচ্চ রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং। এসবের একটি গাউছিয়া টুইন পিক নামের ১৪ তলা ভবন। কাচে মোড়ানো সুদৃশ্য ভবনটিতে রয়েছে ছোট বড় ২০টি রেস্তোরাঁ। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে এ ভবনে লিফট ছাড়া ব্যবহারকারীর সিঁড়ি ব্যবহারের সুযোগ নেই। স্থপতির নকশার বাইরে গিয়ে ডেভেলপার কোম্পানি এ ভবনের ফায়ার এক্সিটের দরজা খুলে ফেলেছে। মানুষ ফায়ার এক্সিট ব্যবহার করতে পারেন না। আবার ফায়ার এক্সিটের মধ্যে স্টোরেজ করা হয়েছে, সেখানে সিলিন্ডার রাখা হয়েছে। বেইলি রোডের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস থেকে এরই মধ্যে এ ভবনটির মালিককে সতর্কতামূলক চিঠি পাঠানো হয়েছে। ভবনটির নকশাবিদ স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকায় রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং করা এখন ট্রেন্ড। বনানী, গুলশানসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অহরহ এসব রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং গড়ে উঠছে। তিনি আরও বলেন- ধানমন্ডি, গাউছিয়া টুইন টাওয়ারটির ডেভেলপার, নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং জমির মালিকদের এর নিরাপত্তা নিয়ে যে সমস্যা আছে তা বলে আসছি। তাদের জানিয়েছি যে, এ ভবনে এতগুলো রেস্টুরেন্ট কোনোভাবেই দেওয়া উচিত নয়। ভবনটি ভয়াবহ একটি টাইমবোমায় পরিণত হয়েছে। আমি মানুষদের এ ভবনটিতে না যাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করছি। বেইলি রোডের ভবনটির চেয়েও ধানমন্ডির ভবনটি আরও বড়, যা ১৪ তলা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যদি কোনো দুর্ঘটনা এখানে ঘটে তাহলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে সাতমসজিদ রোডের ভবনটির জমির মালিক আমার কাছে করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমি সোজাসাপ্টা তাকে জানিয়েছি- প্রথমেই ভবনটি থেকে তাদের সব রেস্টুরেন্ট সরাতে হবে। একটি ভবন দেখতে সুন্দর বলেই সেখানে বিনোদনের জন্য মানুষ চলে গেল; কিন্তু দৃষ্টিনন্দন ভবন, জীবনের চেয়ে বড় না। এখানে নিরাপত্তাই প্রথমে আসা উচিত।

ধানমন্ডির মতোই রাজধানীর মিরপুর এলাকায় যত্রতত্র গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং ও খাবার হোটেল। মিরপুর ১২ নম্বর এলাকায় কেএফসি ভবন নামে পরিচিত নয় তলা ভবনটিতে আছে ডোমিনোজ পিৎজা, খানাস, বার্গার কিং, কেএফসি, বিএফসিসহ অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। কিছুদিন আগে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সুউচ্চ ভবনের ওপরে যাওয়ার জন্য সরু লিফট ব্যবহার করা হয়েছে। এতে নেই জরুরি বহির্গমনের আলাদা পথ। একটি সিঁড়ি ব্যবহার করা হলেও তা এতই সরু যে, সেই সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামলে আর ওপরে যাওয়ার জায়গা থাকে না। ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি। গতকাল ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায় ভবনটি বন্ধ রাখা আছে। ভবনটির একমাত্র প্রবেশপথের গেট বন্ধ। এর সামনে বসে থাকা এক দারোয়ান বলেন, ‘ভবনের সংস্কার কাজ করবে। এ জন্য এক সপ্তাহ এ ভবনটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভবনের মালিক।’ মিরপুরের মতো রাজধানীর খিলগাঁও ও উত্তরা এলাকায়ও সুউচ্চ ভবনে গাদাগাদি করে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চলছে। এসব ভবনের বেশিরভাগেই আছে অগ্নিঝুঁকি। বিশেষ করে এসব ভবনের বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডারের মজুদ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের রেস্টুরেন্টগুলো আইন মেনে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা তদারকি যে সংস্থাগুলোর করার কথা তারা এ ব্যাপারে উদাসীন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি যে, পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ-এর আদলে আমাদের সংগঠন চালাতে চাই। এর মাধ্যমে সব রেস্টুরেন্ট আমরা নজরদারি করতে পারব। এতে কোনো ব্যবসায়ী যাতে কমপ্লায়েন্সের বাইরে ব্যবসা করতে না পারেন তা নজরদারি করা যাবে। কিন্তু এখানে যে যেভাবে পারছে রেস্টুরেন্ট দিয়ে ব্যবসা করছে। সরকারি হিসেবে সারা দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার রেস্টুরেন্ট আছে। এর মধ্যে সারা দেশে ৬০ হাজার রেস্তোরাঁর নিবন্ধন আছে এবং রাজধানীতে আমাদের সদস্য ৫ হাজারের মতো।

সর্বশেষ খবর