শিরোনাম
সোমবার, ৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

হরতালে অচল হয়ে পড়ে দেশ

শরীফ নুরুল আম্বিয়া

হরতালে অচল হয়ে পড়ে দেশ

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা। ১ মার্চ হঠাৎই অধিবেশন স্থগিত করলেন ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য বুঝতে বাকি থাকল না। তারা ক্ষমতা দিতে চাইছে না। বিক্ষোভে ফেটে পড়ল ছাত্রযুব সমাজ। ওই দিনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশাল জনসমাবেশ হলো পল্টনে। ঘোষণা এলো হরতালের। ২ মার্চ মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায়। ৩ তারিখে পল্টনে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ঘোষণা হলো স্বাধীনতার ইশতেহার। আমাদের মনে স্বাধীনতার যে স্বপ্ন ছিল তা ফুটে উঠেছিল ইশতেহারে।ওই সময়ের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ইশতেহার পাঠ করলেন পল্টনভরা মানুষের জনসভায়। ইশতেহারে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি এবং বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। নির্ভেজাল গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সংগীত, মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা সর্বত্র তুলে ধরা, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের কথা বললেন, আরও জানালেন ৭ তারিখের মিটিংয়ে সব বলবেন। পরদিন ৪ মার্চের হরতালে জনগণ অভাবনীয় সাড়া দেয়। দেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। ২ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোরে উঠেই ছুটতাম হরতাল করতে। সবকিছু বন্ধ করে দিই আমরা। সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকায় তখন রিকশাও ছিল হরতালের আওতায়। ৪ মার্চ নাগাদ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আদালত, শিল্প-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাস-রেল-স্টিমার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব বন্ধ হয়ে যায়। কার্যত অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ। আমাদের স্লোগান ছিল- বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর; গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর; মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালিরা এক হও- মুহুর্মুহু এসব স্লোগানের মধ্য দিয়ে ৩ তারিখের সভা চলতে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের প্রশ্নে যেসব উপাদান দরকার ছিল সেগুলো উনসত্তরের আন্দোলন থেকেই আমরা অনেকটা অর্জন করেছি। একজন নেতা দরকার ছিল, যিনি দায়িত্ব নেবেন। নিউক্লিয়াসের নেতারা বঙ্গবন্ধুর ওপর সেই আস্থা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুও এই যুব নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন, সত্তরের নির্বাচনে ম্যান্ডেটের পর তা আরও সুসংহত হয়। যখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়া হলো তখন মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই খুঁজেছে। তারা পূর্বাণীতে গেছে, যেখানে বঙ্গবন্ধু মিটিং করছিলেন। ১ মার্চের পর ছাত্রদের মধ্যে বাঙালির মুক্তির প্রশ্নে যে কৌশলগত বিভেদ ছিল তা মিটে গেল। মার্চের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন। সংগঠনটি ঘোষণা দিল- এরপর আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির যে ডাক দিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার যে আহ্বান জানালেন, আলোচনার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর যে শর্ত আরোপ করলেন, তা করার মতো উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। নেপথ্যে ছিল নিউক্লিয়াস। এ সময়ের একজন কর্মী হিসেবে আমি নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করি। আমাদের সশস্ত্র স্বাধীনতা ও মুক্তির মহান সংগ্রামের পটভূমিতে ছাত্র-যুব-জনতার যে সৃজনশীল ও গৌরবময় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে তা স্মরণ করলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পাবে।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি।

সর্বশেষ খবর