বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
কর্ণফুলীতে মিশছে বর্জ্য

তিন দিন ধরে জ্বলছে চিনি গুদামের আগুন

আজহার মাহমুদ, ইছানগর থেকে ফিরে

তিন দিন ধরে জ্বলছে চিনি গুদামের আগুন

এস আলম গ্রুপের চিনি কারখানার গুদামের আগুন তৃতীয় দিনেও নেভেনি। আগুন নেভাতে টানা পানি ছিটানোর ফলে অপরিশোধিত চিনি পুড়ে তরল বর্জ্যে রূপান্তরিত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে এবং নদীতে ভাসছে কেমিক্যাল। ফলে নদীর জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। ভেসে উঠছে শত শত মাছ ও জলজ প্রাণী। কারখানার আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে উৎকট গন্ধ।

গত সোমবার বিকালে চট্টগ্রামের একমাত্র চিনিকল এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের একটি গুদামে আগুন লাগে। গতকাল বিকাল ৫টায় এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্তও জ্বলছিল আগুন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতে টানা পানি ছিটিয়ে গেলেও নিভছে না আগুন। দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির কর্তারা দাবি করেছেন, আগুন তিন ভাগের এক ভাগ নিভে গেছে।

পোড়া বর্জ্য নদীতে, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য : প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী ওই গুদামে ১ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি ছিল। এসব চিনির পুরোটাই পুড়ে গেছে। পোড়া চিনির ওপর টানা পানি ছিটানোর ফলে এক ধরনের কালচে বর্ণের তরলে পরিণত হচ্ছে। এসব তরল পার্শ্ববর্তী ড্রেন হয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। মঙ্গলবার রাত থেকে নদীর যে অংশে তরল বর্জ্য গিয়ে পড়ছে সে অংশের পানি বিবর্ণ হতে শুরু করে। নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণী নদীর কিনারে আসতে থাকে। গতকাল সকাল থেকে টেংরা, চিংড়ি, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী নদীর পানিতে ভাসতে থাকে। এ সময় স্থানীরা পানিতে নেমেই এগুলো ধরতে পারছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোড়া চিনি পানিমিশ্রিত হয়ে কেমিক্যালে রূপান্তরিত হয়ে জীববৈচিত্র্যকে হুমকিতে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের ল্যাবে নদীর পানি পরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটির চিফ কেমিস্ট কামরুল আলম জানান, চিনি পুড়ে কার্বনডাই অক্সাইড হয়ে নদীতে মিশছে। কেমিক্যাল নদীতে মেশার ফলে নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে সামুদ্রিক প্রাণী ভেসে উঠছে। একই মত পোষণ করেছে জেলা মৎস্য দফতরও।

কারখানার আয়তন ও ক্ষতির হিসেবে ধোঁয়াশা : প্রতিষ্ঠানটির দাবি, গুদামটির আয়তন ৬৫ হাজার বর্গফুট। সেখানে ১ লাখ মেট্রিক টন বা ১০ কোটি কেজি চিনি ছিল। প্রতি কেজি ১০০ টাকা হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। যদিও ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, গুদামটির আয়তন ৩০-৩৫ হাজার বর্গফুট ও উচ্চতায় পাঁচতলা ভবনের সমান হতে পারে। এই আকারের গুদামে কী পরিমাণ চিনি রাখা যেতে পারে সে বিষয়ে ধারণা দিতে পারেননি ওই কর্মকর্তা। কারখানার একাধিক কর্মকর্তাকে সোমবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত গুদামে রাখা চিনির পরিমাণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করতে দেখা গেছে।

এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসেবে, দেশে ২০২৩ সালে ১৭.১২ লাখ, ২০২২ সালে ২১.৫১ লাখ, ২০২১ সালে ২১.৯৬ লাখ ও ২০২০ সালে ১৭.১২ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়। গত ১ জানুয়ারি থেকে সোমবার পর্যন্ত ৪.৭৪ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের আমদানির পরিমাণ ১.১২ লাখ টন। এ ছাড়া সিটি গ্রুপ ১.৬১ লাখ টন, মেঘনা গ্রুপ ১.৫৬ লাখ টন আমদানি করেছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানির পরিমাণ হাজার টনে সীমাবদ্ধ। শিল্প গ্রুপটির দাবি অনুযায়ী, ওই কারখানার চারটি গুদামে ৪ লাখ মেট্রিক টন চিনি আছে, যার মধ্যে ১ লাখ মেট্রিক টন পুড়ে গেছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে ১.১২ লাখ মেট্রিক টন চিনি আমদানির বিষয়টি উল্লেখ করলে গ্রুপের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মোস্তান বিল্লাহ আদিল বলেন, ‘আমাদের এখানে দুই মাস আগের চিনিও আছে।’

প্রভাব চিনির বাজারে : মঙ্গলবার সকালে শিল্প গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে চিনির দাম না বাড়ার আশ্বাস দিলেও ওইদিন দুপুরের পর থেকেই চট্টগ্রামে কেজিতে ২-৪ টাকা চিনির দাম বেড়েছে। গত দুই দিনে খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে প্রতি কেজি চিনিতে অন্তত ২ টাকা এবং খুচরায় বেড়েছে ৩-৪ টাকা। এ প্রসঙ্গে গ্রুপের জি এম মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিনি কারখানায় আগুনের কারণে বাড়তি দামে চিনি বিক্রির চেষ্টা করতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা আগেই সতর্ক করেছি। আমাদের পর্যাপ্ত চিনিও মজুদ আছে।’

নেভেনি আগুন : কারখানাটিতে আগুন লাগে সোমবার বিকাল ৪টায়। ছয় ঘণ্টা পর আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ওইদিন দিবাগত রাত, মঙ্গলবার ও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্তও আগুন পুরোপুরি নেভেনি। চিনির কাঁচামালে অক্সিজেন ও কার্বনের উপস্থিতি থাকায় সহজে আগুন নেভানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। বুধবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত কারখানার অভ্যন্তরে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের কর্মীদের নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে দেখা গেছে। তবে ইতোমধ্যে গুদামের প্রায় অর্ধেক অংশের আগুন নিভেছে বলে জানা গেছে। কারখানাটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা।

 

সর্বশেষ খবর