সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

চারদিকে মরণযাত্রার দালাল

ঢাকা ও দুবাইয়ে অবস্থান করে লিবিয়া-বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ দেশে ভাগ করে নিয়েছে এলাকা, কিছুই হয় না মানব পাচারকারীদের

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর

লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর নৌকায় পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পাঠানোর ‘মরণযাত্রা’র জন্য মাদারীপুরের সবখানেই সক্রিয়। এসব দালালচক্র মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে  ফেলে তারা। ইতালি পাঠানোর কথা বলে তারা জনপ্রতি ১০  থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে মানুষ তাদের জমিজমা বিক্রি করে দিচ্ছে। ঢাকা ও দুবাইয়ে অবস্থান করে লিবিয়া-বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করা চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানীয় দালালরা। ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে প্রথমে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা নিয়ে দালালরা বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে লিবিয়া পাঠায়। এরপর সেখান  থেকে নৌপথে ইউরোপের দেশ ইতালি পাঠানোর কথা বলে। এর মধ্যেই বিদেশগামীদের বিপত্তিতে পড়তে হয়। নৌপথে পাড়ি দিতে গিয়ে স্থানীয় মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়ে তারা। টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার পাশাপাশি অনেককেই প্রাণ হারাতে হয় ভূ-মধ্যসাগরে।

ভুক্তভোগী অনেক পরিবার জানায়, কৌশলে আরও টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য মাফিয়া চক্রের কাছে ধরিয়ে দেয় দেশি দালাল চক্র। মাফিয়ারা তাদের লিবিয়ার বিভিন্ন টর্চার সেলে নিয়ে বন্দি করে রাখে। সেখানে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এ ছাড়া পানি ও খাবার বন্ধ কওে দেওয়া হয়। ওই টর্চার  সেল থেকে ছাড়ানোর জন্য পরিবারের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করে দালাল চক্র। এরপর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়। এভাবে ফের নৌপথ দিয়ে পাড়ি দিতে গিয়ে একাধিকবার মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়তে হয় ভুক্তভোগীদের। বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা খোয়াতে হয়। অনেক পরিবার আছে, যারা প্রশাসন ও সাংবাদিকদের কাছে এ নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। কারণ, তথ্য ফাঁস করে দিলে মাফিয়ারা তাদের সন্তানদের মেরে ফেলবে। বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দালালদের অধিকাংশই ঢাকা শহরে বসবাস করে। এক একটি মোবাইল সংযোগ ২০-২৫ দিনের বেশি তারা ব্যবহার করে না। মাদারীপুরে এই দালালদের একাধিক চক্র সক্রিয়। এর মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর সদর উপজেলার বড়াইলবাড়ী গ্রামের জামাল খাঁ, কেন্দুয়ার বোম্বাই রিপন, বালিয়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেন, মাদারীপুর শহরের ডিসি ব্রিজ এলাকার রাশেদ খান ও টুলু খান। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের তুলাতলা। মাদারী শ্রীনাথদি বাজিতপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, ধুরাইল ইউনিয়নের চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, আলমগীর, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাস তালুকদার, হোসেনপুরের জাকির হোসেন,  টেকেরহাটের লিয়াকত মেম্বার, কদমবাড়ীর রবিউল ওরফে রবি, শাখারপাড় গ্রামের কামরুল মোল্লা, এমরান মোল্লা, আমগ্রাম ইউনিয়নের কৃষ্ণার মোড় এলাকার শামীম ফকির, সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের শহিদুল মাতুব্বর ও সিরাজ মাতুব্বর দালাল হিসেবে সক্রিয়।

এসব দালালের গডফাদার হচ্ছে লিবিয়ায় অবস্থানরত মাফিয়া শরীফ ও আশরাফসহ বেশ কয়েকজন। শরীফের শ্বশুরবাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলা শিরখাড়া ও আশরাফের শ্বশুরবাড়ি সদর উপজেলার খোয়াজপুরে। এই সূত্রে তাদের শক্ত সিন্ডিকেট রয়েছে মাদারীপুরে। এ চক্রের সঙ্গে রয়েছে বেশকিছু নারী দালালও। তারা কমিশনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিদেশগামী যুবকদের সংগ্রহ করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিবিয়ায় আটকে রেখে যে নির্যাতন করা হয়, এর দেশি মূলহোতা কুমিল্লার বাসিন্দা শরীফ। তিনি মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের নতুন মাঠ গ্রামের সাকা মাতুব্বরের মেয়ে সুমিকে বিয়ে করেন শরীফ। সুমিসহ একাধিক দালাল মাদারীপুর সদর, শিবচর, কালকিনি, ডাসার, রাজৈর ও পাশের জেলা  গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে লোক সংগ্রহ করে লিবিয়ায় পাঠায়। লিবিয়ায় যারা নির্যাতন করে, তাদেরই একজন আজিজুল ইসলাম নির্ঝর। তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামের আবুল কালাম হাওলাদারের ছেলে। তিনি লিবিয়ায় পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর জোয়ারা ক্যাম্পের মাফিয়া শরীফ হোসেনের সহযোগী। তার দায়িত্ব বন্দিদের নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা। নির্যাতন করার জন্য নির্ঝরকে প্রতি ঘণ্টায় ৩০ হাজার টাকা দেয় শরীফ। সদর উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের ভুক্তভোগী রাকিব ফরাজী বলেন, শরীফের ক্যাম্পে নির্ঝর আমাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর আবারও মেরেছে। মারার ফলে আমার চোখে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। ক্যাম্পে থাকার দুই মাসের মধ্যে নির্ঝরের নির্যাতনে দুই যুবক মারা গেছে। আরেক ভুক্তভোগী ডাসার উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বনি আমিন। তাকে মুক্তিপণের জন্য কয়েক দফায় নির্যাতন চালানো হয়। পরে শরীফের স্ত্রী সুমির এজেন্ট ব্যাংকিং নম্বরে ২০ লাখ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে নিজ বাড়িতে ফিরেছেন অভিযুক্ত আজিজুল হক নির্ঝর। মুক্তিপণের দাবিতে নির্যাতনের বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, আমি নিজেও কাজের সন্ধানে লিবিয়া গিয়েছিলাম। আমাকে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়ারা বন্দি করে শরীফের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পের বন্দিরা সবাই অনেক কান্নাকাটি করত। আমি ভাষা জানতাম বলে সবাইকে চুপচাপ রাখতে শরীফ আমাকে ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়েছিল। সে সময় অনেককেই গালাগালি করেছি, তাই ক্ষুব্ধ হয়ে আমার নামে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি কারও কাছ  থেকে মুক্তিপণ আদায় করিনি। তবে শুনেছি, ওখানে সাড়ে ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। আমার নামে করা অভিযোগ সত্য নয়।

তবে দেশে আসার পরপরই একাধিক ভুক্তভোগী দলবদ্ধ হয়ে নির্ঝরকে জুতাপেটা করেন। তাকে জুতার মালা গলায় দিয়ে ভিডিও ধারণও করা হয়। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে।

পুলিশ সুপার কার্যালয়ের তথ্য মোতাবেক, মাদারীপুরের বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ২৯২টি ও আদালতে ৩৭টি। মামলায় মোট আসামি ১৪৬৬ জন হলেও গ্রেফতার হয় মাত্র ২৮৭ জন। আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় ৯৬টি মামলার, আর আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়ে ৮৭টি মামলার। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ১১১টি মামলা মীমাংসা হওয়ায় বাদী মামলা প্রত্যাহার করেছেন। মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, মাদারীপুর তথা দক্ষিণাঞ্চলে মূলত নেই কোনো কলকারখানা। নেই কর্মসংস্থান। তাই বিদেশ যাওয়ার দিকে ঝুঁকছে মানুষ। অন্যদিকে যারা বিদেশ যাচ্ছে তারা দেশে এসে বহুতল ভবন তৈরি করছে। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাচ্ছে। এদের দেখাদেখি লেখাপড়া শেষ না করেই বিদেশ যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু করে অনেকেই। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি হচ্ছে শতে শতে যুবক। তাই তিনি এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামাতে স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবি জানান।

মাদারীপুরের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার কামরুল হাসান বলেন, অনেক ভুক্তভোগী দেশে ফিরে মানব পাচার আইনে মামলা করেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপস করে ফেলে। যার কারণে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। তিনি বলেন, মানব পাচার  ঠেকানোর জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ হলো অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা। মূলত মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে এগিয়ে আসা দরকার।

সর্বশেষ খবর