সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

লিবিয়ার বন্দিশিবিরে দুর্বিষহ জীবন

মাদারীপুর প্রতিনিধি

দালালদের খপ্পরে পড়ে হাজারো যুবক বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন লিবিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবিরে। সেই বন্দিশিবিরের জীবন ভয়াবহ। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা গ্রামের কিশোর মন্ডল (১৮)। ২০২২ সালে তিনি লিবিয়া যান। দেড় বছর সেখানে ছিলেন তিনি। এই দেড় বছরে লিবিয়া থেকে নৌপথে চারবার ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান প্রতিবারই। ধরা পড়ার পরের দিনগুলো ছিল বিভীষিকাময়।

কিশোরের বাবা নিরঞ্জন মন্ডল বলেন, ধরা খাওয়ার পর কিশোরকে স্থানীয় দালাল চক্র এক ঘরে বন্দি করে রাখে। সেখানে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। পানিও দেওয়া হতো না। উল্টো মারধর করা হতো। দীর্ঘদিন গোসল না করায় জীবনের শরীরে ঘা হয়ে গেছে। নৌপথ পাড়ি দেওয়ার সময় বাংলাদেশের দালালরাই লিবিয়ার ওই চক্রকে জানিয়ে দিয়ে ধরিয়ে দিত। পরে আমাদের কাছ থেকে আরও টাকা নিয়ে ওরাই আবার ছাড়িয়ে দিত। কিশোরকে দেড় বছরে তিনবার ধরিয়ে দিয়েছে তারা। শেষে তারা মাফিয়ার কাছে ধরিয়ে দেয় কিশোরকে। দালালদের মাধ্যমে ১৩ লাখ টাকা দিয়ে তাকে ছাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যেতে তিন ধাপে দালাল চক্রকে টাকা দিয়েছি। শুরুতে নগদ ৫ লাখ টাকা দিয়েছি। লিবিয়া পৌঁছানোর পর নৌপথে ইউরোপ যেতে ব্যাংকের মাধ্যমে সাড়ে ১১ লাখ দেওয়া হয়। তারপরও ইউরোপে যেতে পারেনি সে। মাফিয়ার হাতে ধরা খাওয়ার পর আবার ১৩ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়।

জীবনের বাবা নিরঞ্জন মন্ডল বলেন, ছেলেকে এক দালাল আরেক দালালের কাছে বেচে দেয়। নৌপথে যাওয়ার সময় তিনবার আটকে দেয়। ছেলে অনেকদিন জেল খেটেছে। মাফিয়া ধরার পর জীবনের ৩-৪ মাস খবরও ছিল না। পরে অনেক টাকা খরচ করে ছেলেকে দেশে আনি। কিন্তু টাকা আর ফেরত পাইনি। কয়েক মাস আগে সেই দালাল মারা গেছে।

জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা গ্রাম থেকে গত ছয় মাসে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন ৭০ জন যুবক। রীতিমতো উৎসব করে এখানকার যুবকরা এই ‘অশুভ’ প্রতিযোগিতায় নামছেন। বেছে নিচ্ছেন মরণযাত্রার ভয়ংকর পথ। অবৈধ পথে পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ সফল হচ্ছেন। আবার অনেকে হারাচ্ছেন প্রাণ। কেউ মানব পাচার চক্রের হাতে পড়ে খোয়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাষাবাদ করে জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়তে হয় এ অঞ্চলের মানুষকে। উচ্চশিক্ষা ও পর্যাপ্ত শিল্প খাত না থাকায় ভাগ্যের চাকা ঘোরে না দক্ষিণাঞ্চলের এই জনপদের মানুষের। অধিকাংশ প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক শিক্ষা হলেই বিদেশ যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দেন অভিভাবকরাও। জমিজমা বিক্রি করে সন্তানকে বিদেশ পাঠাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় মানব পাচার চক্র। গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে ইউরোপের দেশে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এ অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই চক্রের সদস্যরা। স্থানীয়দের কাছে তারা দালাল নামে পরিচিত।

সর্বশেষ খবর