বড়পীর আবদুল কাদের জিলানির (রহ.) বেলাদাত সম্পর্কে দুটি প্রসিদ্ধ মত রয়েছে। একদল জীবনীকার বলেছেন, তিনি মাহে রমজানের পয়লা দিনে পৃথিবীর বুকে এসেছেন। অন্যদিকে হাফেজে হাদিস ইমাম জাহাবি (রহ.) তার সিয়ারে আলামুন নুবলায় উল্লেখ করেছেন, মাহে রমজানের মাঝামাঝি সময়ে বড়পীরের জন্ম। তার পুরো নাম আবু মুহাম্মদ আবদুল কাদির ইবনে আবু সালেহ আবদুল্লাহ ইবনে জঙ্গী দোস্ত ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মদ ইবনে দাউদ ইবনে মুসা ইবনে ইবদুল্লাহ ইবনে হাসান ইবনে আলী ইবনে আবু তালিব কুরাইশি আল জিলানি আল শাফেয়ি হাম্বলী (রহ.)। তিনি বাবা-মা দুই দিক থেকেই আহলে বাইতের সিলসিলা পেয়েছেন। বাবার দিক থেকে হাসানি এবং মায়ের দিক থেকে হোসাইনি। ওলীদের অনেক স্তর রয়েছে। কোনো কোনো ওলী ইবাদত ও সাধনার ফলে ওলী হন। অনেক ওলী আছেন প্রথম জীবনে ডাকাত ছিলেন, সুদ খোর ছিলেন, পরবর্তীতে কোনো এক আল্লাহর ওলীর সোহবতে নিজেও মস্তবড় বুজুর্গ হয়ে গিয়েছেন। ওলীদের আরেকটি স্তর আছে-মাদারজাত ওলী। মায়ের পেট থেকেই তারা ওলী হয়ে জন্ম নেন। বড়পীর ছিলেন মাদারজাত ওলী। মাদারজাত ওলীদের মধ্যেও শ্রেণীভেদ আছে। এখানেও তিনি অন্যদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন। কীভাবে? তার মা ছিলেন কোরআনে হাফেজ। বড়পীর পেটে থাকা অবস্থায় মা কোরআন তেলাওয়াত করতেন, সেটা শুনে শুনে তিনি ১৮ পারা কোরআন মায়ের পেটে থাকতেই হেফজ করে ফেলেন। একটু বড় হওয়ার পর যখন তাকে মক্তবে নিয়ে যাওয়া হল, উস্তাদ তাকে বলছেন, বাবা পড়ো আলিফ-বা-তা-ছা...। শিশু আবদুল কাদের বললেন, উস্তাদ এগুলো আমি অনেক আগে থেকেই পারি। এ বলে তিনি সূরা ফাতেহা থেকে শুরু করে এক বসায় ১৮ পারা কোরআন শুনিয়ে সবাইকে অবাক দিলেন। ওলীদের সর্বোচ্চ স্তর হল গাউসুল আজম। আবদুল কাদের জিলানী ছিলেন আধ্যাত্মিক পথের শিক্ষার্থীদের জন্য গাউসুল আজম। আজকের দিনের বড় সমস্যা হল, আমরা অনেক ওয়াজ শুনি, লেখা পড়ি, কিন্তু সেগুলো আমাদের ভেতর কোনো পরিবর্তন আনে না। ভেতরজগত নাড়া দেয় না। আমলের প্রতি আগ্রহ জাগায় না। এ সমস্যা বড়পীরের সময়ও ছিল। তাই তরিকতের ছাত্রদের তিনি নসিহত করতে গিয়ে তার বিখ্যাত কিতাব ‘সিররুল আসরারে’ বলেছেন, ‘পরহেজগার পীর ছাড়া তরিকতের পথে তুমি একটি কদমও চলতে পারবে না। তাই কার থেকে ইলম নিচ্ছো, কার থেকে তরিকত শিখছ যাচাই করে নাও।’
তরিকতের সালেকদের উদ্দেশ্যে করে বড়পীর বলেন, ‘দেখো! তাওহিদের কালেমা লাইলাহা ইল্লাহর সবক যার তার কাছ থেকে নিও না। যে পীর নিজেকে দুনিয়ামুক্ত করতে পেরেছে, যার ভেতর জগতে আল্লাহর জিকির জারি আছে, যে নিজের মরা দিল জিন্দা করতে পেরেছে, তার থেকে তুমি কালেমা তাওহিদের সবক নিও। মনে রেখো! লাইলাহা ইল্লাল্লাহ এ বাক্যের মধ্যে কোনো জাদু নেই, জাদু আছে ব্যক্তির মাঝে। মরা দিলের ব্যক্তি আর জিন্দা দিলের ব্যক্তি দু’জন তোমাকে এ কালেমার সবক দিতে পারে। কিন্তু মরা দিলের সবক তোমার দিলকে জিন্দা করতে পারবে না। তোমার ভেতর কোনো পরিবর্তন আনবে না। উল্টো মরা দিলের কারো সোহবত তোমার দিল আরো মেরে ফেলবে। কিন্ত যখন তুমি লাইলাহা ইল্লাল্লাহর সবক কোনো জিন্দা কলবের অধীকারী পীরের থেকে নেবে, তার তাজাল্লিয়াতে খোদা তোমার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দেবে। মনে হবে খুব সাধারণ কথা, কিন্তু তাছির অসাধারণ হবে।’ এবার বড়পীর তার বক্তব্যের সমর্থনে কুরআন থেকে দলিল দিচ্ছেন। মরা দিলের মানুষ যখন কালেমায়ে তাওহিদের দাওয়াত শোনে তখন তার ভেতর কী প্রভাব হয় শুনুন। সূরা সাফফাতের ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যখনই মরা দিলের মানুষকে বলা হয় তোমরা বলো লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, তখন তারা অহংকারে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়।’ অন্যদিকে কালব জিন্দা নবীকে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনি জেনে নিন- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আর যারা আপনার এ কথা মেনে নেবে, ওই সব বিশ্বাসী নারী-পুরুষদের জন্য আপনি ইস্তেগাফার করুন। অর্থাৎ তাদের কালো দিল সাদা করে তাদের কলবও জিন্দা করে দিন।’ (সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ১৯। ) বড়পীরের এ ছোট্ট আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, মাহে রমজানের যে ইবাদতগুলো পালন করব, সেগুলো যেন কোনো জিন্দাদিল মুর্শিদের সোহবতে থেকে করা হয়। তাহলে আমাদের এবারের রমজান হবে সোনায় মোড়নো এক ভিন্ন রমজান। আল্লাহ আমাদের কবুল করুণ। আমিন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর, www.selimazadi.com