বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

পরিবারে আহাজারি

কাঁদছেন প্যারালাইজড বাবা, সন্তানকে ফেরানোর আকুতি

প্রতিদিন ডেস্ক

পরিবারে আহাজারি

জিম্মি নাবিকের পরিবারে আহাজারি। নেত্রকোনা থেকে গতকাল তোলা ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সোমালিয়ায় বাংলাদেশি জাহাজ অপহরণের ঘটনায় আটকে পড়াদের গভীর উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। তাদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। তাদের উদ্ধারে সরকারসহ সব মহলের সহায়তা চাইছেন তারা। এসব বিষয়ে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

জলদস্যুদের কবলে একমাত্র ছেলে সাব্বির, কাঁদছেন প্যারালাইজড বাবা : টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জলদস্যুদের কবলে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সহবতপুর গ্রামের সাব্বিরের বাড়িতে চলছে স্বজনদের আহাজারি। একমাত্র ছেলের জিম্মির খবর পেয়ে স্বজনরা বুক চাপড়িয়ে কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন। একমাত্র বোন মিতু আক্তার ভাইয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করছেন- তার ভাই এবং সব নাবিক যেন জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বজনদের কাছে আবার ফেরত আসে।

বিপ্লবকে ফিরে পেতে চায় পরিবার : ফেনী প্রতিনিধি জানান, সোমালিয়ায় অপহরণ হওয়া বাংলাদেশি জাহাজে থাকা ২৩ বাংলাদেশির মধ্যে ফেনীর দাগনভুঞা উপজেলার ছেলে ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ বিপ্লবও রয়েছেন। তিনি মাতু ভুঞা ইউনিয়নের সোনাপুর নিবাসী মোমারিজপুর গ্রামের নজির ভুঞা বাড়ির আবুল হোসেনের ছেলে। তিনি ওই জাহাজে ইলেকট্রিশিয়ান পদে কর্মরত। তার স্ত্রী উম্মে সালমা সোনিয়া বলেন, আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে জলদস্যুরা জাহাজটি অপহরণ করে। এ সময় তার স্বামী ওই জাহাজে ডিউটি করছিল। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) রাত ১০টায় তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে। তাদের জিম্মি করে আটকে রাখা হয়েছে বলে বিপ্লব জানিয়েছেন।

নাবিক রুকনের নেত্রকোনার বাড়িতে আহাজারি : নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের বাঘরোয়া গ্রামের কৃষক মিরাজ আলী ও লুৎফুর নাহারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে ৪ নম্বর হলেন নাবিক রুকন উদ্দিন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় ছেলে। বাবা মা বড় ভাই কাজ করে রুকনকে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। ভালো শিক্ষার্থী হওয়ায় তিনি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পাস করেন ২০১৩ সালে। পরে ২০১৫ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। গত বছরের নভেম্বর মাসে কবির স্টিল রোলিং মিলসের (কেএসআরএম) শিপ কোম্পানিতে যোগদান করেন।

পরিবারের সঙ্গে শেষ কথা তৌফিকের, সবাই অনিশ্চয়তায় : জয়ের পরিবারে উৎকণ্ঠা : খুলনা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার তৌফিকুল ইসলামের বাড়ি খুলনা নগরীর ছোট বয়রা করিমনগর এলাকায়। গতকাল ওই বাড়িতে গেলে দেখা গেছে, পরিবারের সদস্যদের চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। কেউ বিছানায় বসে প্রার্থনা করছেন। কেউ বা আঁচলে চোখের পানি মুছছেন। তৌফিকের ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন কেউ। এর আগে মঙ্গলবার বিকাল ৫টায় তৌফিক মোবাইল ফোনে পরিবারের কাছে জাহাজটি দস্যুরা ঘিরে ফেলেছে খবর দেয়। এ সময় স্ত্রীর ফোনে ফোন দিয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

রাজুর বাড়িতে উদ্বেগ : নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, এমভি আবদুল্লাহর ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিকসহ সব যাত্রী সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছেন। প্রায় ৫০ জন সশস্ত্র জলদস্যু জাহাজটিতে উঠে নাবিকদের জিম্মি করে রেখেছে। এই ২৩ জন জিম্মি হওয়া বাংলাদেশি নাবিকের মধ্যে দুজনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। তারা হলেন, এবিল সি-ম্যান (নাবিক) হিসেবে মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক রাজু (২৭) ও ফাইটার হিসেবে মোহাম্মদ সালেহ আহমেদ। এর মধ্যে মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক রাজুর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রামপুর গ্রামের আজিজুল হক মাস্টারের ছেলে। অপরজন ফাইটার মোহাম্মদ সালেহ আহমেদের বিস্তারিত পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

জয়ের পরিবারে উৎকণ্ঠা : নাটোর প্রতিনিধি জানান, সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এবং ২৩ নাবিক ও ক্রুদের মধ্যে রয়েছেন নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জয় মাহমুদ। মঙ্গলবার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর জয় মাহমুদ তার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। এ ঘটনা শোনার পর থেকেই উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তার পরিবার ও স্বজনরা। জিম্মি জয় মাহমুদ জেলার বাগাতিপাড়ার সালাইনগর দক্ষিণপাড়া গ্রামের জিয়াউর রহমানের ছেলে। তিনি ওই জাহাজের সাধারণ নাবিক (ওএস) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

তারেকুলের বাবা-মায়ের আর্তি- ‘আমার সন্তানকে ফিরিয়ে আনুন: ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, জলদস্যুদের হাতে বন্দি তারেকুল ইসলামের গ্রামের বাড়িতে চলছে আহাজারি। সন্তানকে ফিরে পেতে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে করুণা প্রার্থনা করছেন বাবা-মা। আশপাশের প্রতিবেশী ও স্বজনেরাও বাড়িতে ভিড় করেছেন। গতকাল দুপুরে তারেকুলের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালীর ছকড়িকান্দি গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।

বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেছে, তারেকুলের বাবা দেলোয়ার হোসেন নিবিষ্টচিত্তে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। সাংবাদিকদের কাছে এ সময় তারা সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য সবার সহায়তা কামনা করেন। একই সঙ্গে সরকার যাতে ওই জাহাজের সবাইকে জীবিত উদ্ধার করতে পারে সেই আর্তি জানান তিনি।

হোসাইনকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা : বরিশাল থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, অপহৃত বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ২৩ নাবিকের মধ্যে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিষারকান্দি গ্রামের উমারের পাড় গ্রামের হোসাইন মো. আলীর পরিবারে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সদ্য বিবাহিত আলীকে ফেরত পেতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তার স্ত্রীসহ বাবা-মা।

২০১৪ সালে উমারের পাড় ইউবিসি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকায় মেরিন একাডেমিতে লেখাপড়া করেন হোসাইন মো. আলী। পড়াশোনা শেষে করোনাকালে চাকরি নেন বিদেশগামী জাহাজে। বর্তমানে ‘এমভি আবদুল্লাহর’ ইঞ্জিন রুমের অয়েল ম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। গত প্রায় ছয় মাস আগে পিরোজপুর জেলার কাউখালীর রাজাপুর গ্রামের ইয়া মনিকে বিয়ে করেন তিনি।

আটকে থাকারা পানিও পাচ্ছেন না : নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম সাইদুজ্জামান গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে সর্বশেষ স্ত্রী মেহরিমা সাফরিন জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমাদের জাহাজে অ্যাটাক হইছে। জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদের সবাইকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। আমাদের মারধর করেনি। আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত ভালো আছি, দোয়া কইর।’

ইঞ্জিনিয়ার আইয়ুবের বাড়িতে মায়ের আর্তনাদ : লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজে থাকা বাংলাদেশি ২৩ নাবিকের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডেট আইয়ুব খান লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর রায়পুরের রাখালিয়া গ্রামে। প্রায় এক মাস আগে তার বাবা আজহার মিয়া মারা যান। এখনো সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি পরিবারটি। এর মধ্যেই পরিবারের ছোট ছেলে সাগরে ডাকাতদের কবলে রয়েছে। এ শোকে আইয়ুবের মা হোমায়রা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিছুক্ষণ পর পরই ছেলেকে বুকে চেয়ে আর্তনাদ করে ওঠেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর