শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
বিএনপিতে কাটছে না অস্থিরতা

মহাসচিব ফিরলেই সব খোলাসা হবে

কেন্দ্রের নির্দেশ মানছে না তৃণমূল যাচ্ছে উপজেলাসহ স্থানীয় নির্বাচনে

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

মহাসচিব ফিরলেই সব খোলাসা হবে

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশে ফিরলে সব স্পষ্ট হবে বলা হচ্ছে। কারামুক্তির পর থেকেই সাংগঠনিক কার্যক্রমে আগের মতো সক্রিয় নন বিএনপি মহাসচিব। সাড়ে তিন মাস কারাগারে থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। মুক্তির পর সাংগঠনিক তেমন কোনো কার্যক্রমে অংশ নেননি। এরপর চিকিৎসার জন্য ৪ মার্চ তিনি সিঙ্গাপুর গেছেন। তারপর দেশে শারীরিক অসুস্থতার কথা বলছেন। দলের ভেতরে নানামুখী তৎপরতা দেখে তিনি কিছুটা নীরব অবস্থান নিয়েছেন। শুধু ফখরুল নন, বিএনপির আরও অনেক সিনিয়র নেতা এখন হতাশ। এদিকে কেন্দ্রের নির্দেশ মানছে না দলটির তৃণমূল। কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে জাতীয় সংসদ, পৌরসভা, উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন স্থানীয় নেতারা। তাঁরা বলছেন, এভাবে ভোট বর্জন করতে থাকলে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর একসময় দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবেন হাইকমান্ড। লন্ডনে বসে দেশের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায় না। সারা দেশের বিভিন্ন উপজেলায় দলের নেতারা প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। সর্বশেষ কুমিল্লা সিটিতে দুই নেতা ভোট করেছেন। সূত্রমতে, অতীতে ভোট করা-না করার সিদ্ধান্ত আসত লন্ডন থেকে। কেন্দ্র তা বাস্তবায়ন করত। লন্ডনের সব সিদ্ধান্ত তৃণমূল শুনছে না। উপজেলা ভোটে বিএনপির অনেক প্রার্থী থাকবেন।

এদিকে কারামুক্তির পর মির্জা ফখরুল ২০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি দলের কিছু কঠিন চিত্র তুলে ধরেন। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গ সাক্ষাতের পর দলীয় অফিসে আর যাননি। চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছেন। অতীতে দেখা গেছে, জেল থেকে বেরিয়ে দলীয় কার্যক্রমে ব্যস্ত হতেন। দলীয় কার্যালয়ে যেতেন, সরকারের বিরুদ্ধে নানা রকম বক্তব্য-বিবৃতি দিতেন। এবার তেমনটি না হওয়ায় কর্মীদের মাঝে গুজব চলছে-মহাসচিব পদ ছেড়ে স্থায়ী কমিটিতে যেতে চান ফখরুল। যদিও তিনি এ নিয়ে মুখ খোলেননি। তিনি ফিরলে সব স্পষ্ট হবে। বিভিন্ন সূত্র বলছেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ১৮ মার্চ মির্জা ফখরুল দেশে ফিরতে পারেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর প্রায় ৬ কেজি ওজন কমে যায়। ৭৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ নানা রকম জটিল রোগে ভুগছেন। একটু সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় তিনি চিকিৎসকের কথা শুনছেন। জানা গেছে, বিএনপিতে এখন একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে। অর্থাৎ সংগঠন কীভাবে চলবে, সংগঠনের নেতৃত্বে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থাকবেন না অন্য কেউ আসবেন, তা নিয়ে দলের মধ্যে চলছে নানা আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্ক। আর এ কারণেই স্পর্শকাতর এ সময়ে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য বা সরকারের সমালোচনা ইত্যাদি থেকে দূরে সরে আছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ মুহূর্তে তারেক রহমানের উচিত বিএনপির নীতিনির্ধারক স্থায়ী কমিটির সদস্যদের ওপর দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। কেননা লন্ডনে বসে দেশের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তিনি বলেন, দলের সব সিদ্ধান্তই যদি লন্ডন থেকে আসে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কাজ কী? মহাসচিবের ক্ষমতা কতটুকু? যতদিন পর্যন্ত মহাসচিবকে তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে দেওয়া হবে না, সাংগঠনিক কার্যক্রমে সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ নেওয়া হবে না ত দিন পর্যন্ত বিএনপির কোনো উন্নয়ন হবে না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় দল বিপর্যয়ে পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনীতির ব্যাপারে মির্জা ফখরুলের এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপির আন্দোলনের ব্যর্থতা, নির্বাচন এবং সামনে যে বিএনপির জন্য অনিশ্চয়তার সময়, এটিই এই রাজনীতিবিদকে হতাশ করেছে। দু-একজন নেতার কাছে তিনি নির্বাচন-পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতি এবং জনগণের নিরাসক্ত ভাব নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেছেন। আর এ সময় হতাশার কারণেও তিনি নির্বাচনের আগে যে রকম উদ্দীপ্ত ও আগ্রহী ছিলেন, এখন সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তবে যে কারণেই হোক মির্জা ফখরুল ইসলামের নীরবতা বিএনপিকে নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মির্জা ফখরুল এ মুহূর্তে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য নেতা। কূটনৈতিক অঙ্গনে তাঁর ইমেজ আছে দেশে-বিদেশে। বিএনপির অন্য নেতাদের তা নেই।

সূত্রমতে, এক দফা দাবিতে বিএনপির বছরের অধিক সময় ধরে চলা রাজপথের আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না আসায় দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে ঝিমিয়ে পড়েছে সারা দেশের সংগঠন। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বলছেন, কেন্দ্রের নির্দেশনা রয়েছে-বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাঁরা দলছেন, এভাবে দল চলতে পারে না। ভোট বর্জন অব্যাহত থাকলে সাংগঠনিকভাবে দল শেষ হয়ে যাবে। এজন্যই তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলছেন, গত ৯ মার্চ ত্রিশাল পৌরসভার উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন উপজেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম আমিন সরকার। তিনি ১০ হাজার ২৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ময়মনসিংহ-৭ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য এ বি এম আনিছুজ্জামানের স্ত্রী শামীমা আক্তার পেয়েছেন ৫ হাজার ৩৪৫ ভোট। একই দিন জামালপুরের বকশীগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে ৮ হাজার ৫৪২ ভোট পেয়ে মেয়র হয়েছেন সদ্যবহিষ্কৃত বিএনপি নেতা মো. ফকরুজ্জামান মতিন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন তালুকদার বাবুল ৭ হাজার ৫৪৩ এবং সাবেক মেয়র ও পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক জগ প্রতীকের প্রার্থী নজরুল সওদাগর পেয়েছেন ৭ হাজার ৪২০ ভোট। তৃণমূল নেতারা বলছেন, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও কেন্দ্রের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ভোট করবেন। কুমিল্লা সিটিতে দুই প্রার্থী না থাকলে লড়াই হতো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবদল সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে দলের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখার জন্য এবার তিনি চেয়ারম্যান পদে ভোট করছেন। তিনি বলেন, যদিও এ নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হবে না তবু নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখা ও ঐক্য ধরে রাখার জন্য ভোট করছেন। উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জয়ের ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ শাহিনুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার দুবারের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেন ভূইয়া দুলাল বলেন, নির্বাচন করতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে দল যে সিদ্ধান্ত নেবে তা-ই করব। ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন শুরু হয়। বিএনপি ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। বরং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে। এর আগেও সিটি করপোরেশন বা ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। তা সত্ত্বেও দলটির তৃণমূলের অনেক নেতা অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে দেড় শতাধিক প্রার্থী বিজয়ীও হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত যারা অমান্য করবেন, অতীতের মতোই ওইসব নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটিই তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্ত। তাই দলের এ সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সামগ্রিক প্রসঙ্গে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার অপপ্রচার চালিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা নেতৃত্বের অধীনে নেই। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোর করে কয়েকজনকে নির্বাচন করিয়েছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, এ নির্বাচনের তারিখ এখনো ঘোষণা হয়নি, কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে নেতা-কর্মীরা ভোটে অংশ নিচ্ছেন বিষয়টি অনুমাননির্ভর। তবে আমরা সামগ্রিকভাবে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রসঙ্গে বলেন, তাঁর সঙ্গে তিন মাস কারাগারে ছিলাম। ৭৭ বছর বয়সী মির্জা ফখরুলসহ আমরা কেউ ভালো চিকিৎসা পাইনি। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আছেন। সরকারের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। আশা করি, আগামীতেও তিনি অতীতের মতোই রাজপথে সরব থাকবেন। দলের হাইকমান্ড তারেক রহমান প্রসঙ্গে বলেন, নেতা-কর্মীদের নানা বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে, ক্ষত থাকতে পারে। আজ পর্যন্ত তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি কারও দ্বিমত নেই।

সর্বশেষ খবর