বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

পূর্ববর্তী উম্মতের জন্যও ছিল সিয়ামসাধনা

সেলিম হোসাইন আজাদী

পূর্ববর্তী উম্মতের জন্যও ছিল সিয়ামসাধনা

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়ামসাধনা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। আশা করা যায় তোমরা মুত্তাকি হতে পারবে।।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত ১৮৩। ) আরবি সিয়াম শব্দের অর্থ কোনো কিছু থেকে বিরত থাকা। সিয়ামের আরেকটি অর্থ হল সব ধরণের কাজ কর্ম বন্ধ করে দেওয়া বা নিশ্চল থেমে থাকা। তাফসিরে মাজাহরিতে সিয়াম শব্দের বিশ্লেষণ উল্লেখ করতে গিয়ে লেখক বলেন, ‘সাওম শব্দের অর্থ থেমে থাকা। মধ্য দুপুরকে আরবরা ‘সামান নাহার’ বলে থাকে। এর অর্থ হল দিন থেমে আছে। মধ্য দুপুরে সূর্য ঠিক মাথার ওপরে থাকে। তখন মনে হয় সূর্য নিশ্চল। যদিও সূর্য ক্রম চলমান রয়েছে। শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট সজন্য নিয়তের সঙ্গে পানাহার ও যৌন ক্রিয়া বন্ধ রাখাকে সাওম বলে।’ (তাফসিরে মাজহারি, ১ম খন্ড, ৩৫৬ পৃষ্ঠা। ) সাওম শব্দের বিশ্লেষণে বিদগ্ধ আলেম মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ তার তাফসিরে লেখেন, ‘সিয়াম অর্থ সওম পালন করা। আর সওম অর্থ নিবৃত্ত থাকা, আত্ননিয়ন্ত্রণ করা। ইসলামের আলোকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকা সিয়ামের প্রধান করণীয়। যদিও শরিয়তে আরো বেশ কিছু করণীয় বিষয় বলে দিয়েছে যেগুলো পালন করার মাধ্যমে সিয়াম পূর্ণতা লাভ করে। সিয়ামসাধনার মূল অনুসঙ্গ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন। কেউ যদি তাকওয়া অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে সে যতই না খেয়ে থাকুক কিংবা স্ত্রী থেকে দূরে থাকুক এতে কোনো লাভ হবে না।’ (তাফসিরসহ কোরআন শরিফ, ১ম খন্ড, ১৭৬ পৃষ্ঠা। ) আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) হজরত হাসান বসরির (রহ.) সূত্রে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদি নয় বরং পূর্ববর্তী সব উম্মতের জন্যই ফরজ ছিল।’ এখানে পূর্ববর্তী উম্মত বলতে আহলে কিতাবদের বোঝানো হয়েছে। পূর্ববর্তী উম্মতের রোজার ধরণ সম্পর্কে ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘তাদের রোজা শুরু হত এশার নামাজ শেষে শোয়ার পর থেকেই।’ অর্থাৎ, রাতে ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের রোজা শুরু হয়ে যেত। উম্মতে মুহাম্মাদীর ওপর আল্লাহ তায়ালা সেহরি খাওয়ার সুযোগ দিয়ে রোজাকে আরো আরো সহজ করে দিয়েছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ২য় খন্ড, ৫০১ পৃষ্ঠ। ) পূর্ববর্তীতের সিয়ামের আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ.) সাঈদ বিন জোবায়েরের (রা.) সূত্রে উল্লেখ করেন, ‘পূর্ববর্তী উম্মতের রোজা শুরু হত রাতের আঁধার গাঢ়ো হওয়ার পর থেকেই। ইসলামের প্রাথমিক সময়েও এভাবেই রোজা পালন করতে হত। কয়েকজন সাহাবি রাতে দুর্বল হয়ে খেয়ে ফেলতেন আবার কেউ কেউ স্ত্রী সহবাস করে ফেলতেন। পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত খাওয়া ও যৌনাচারের অনুমতি দিয়ে উম্মতের মুহাম্মাদীর জন্য সহজ করে দেন। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও মাহে রমজানের এক মাস রোজা রাখা ফরজ ছিল। একদল আলেমের মতে, খ্রিস্টানরা এক মাসের রোজা পালন করতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে যায়। প্রচন্ড গরমের কারণে তাদের অনেকই রোজা রাখতে পারত না। আবার শীতের মৌসুমেও তাদের পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব হত না। এমন পরিস্থিতিতে তাদের আলেমরা সিদ্ধান্ত নিল- গরম কিংবা শীতে নয় বরং বসন্তকালে তারা রোজা রাখবে। আর রোজার সময় পরিবর্তনের জন্য রোজার সংখ্যা ১০টি বাড়িয়ে নিলো। এখন থেকে প্রতি বছর বসন্তকালে তারা ৪০টি রোজা পালন করবে। এভাবে চলল কয়েক বছর। তারপর একবার হঠাৎ করে তাদের রাজা দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পরে। রাজার সুস্থ্যতার জন্য তারা ৪০টির সঙ্গে আরো ১০টি রোজা বাড়িয়ে রাখবে বলে মানত করল। আল্লাহ রাজাকে সুস্থ্য করে দিলেন। এখন প্রতি বছর তাদের ৫০টি করে রোজা রাখতে হচ্ছে। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, এক মহামারীতে খ্রিসন্টানদের ব্যপাক প্রাণহানি হয়। মহামারী থেকে বাঁচতে তারা আরো ১০টি রোজা বাড়িয়ে রাখার মানত করে। এভাবে তাদের রোজার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ষাট দিন বা টানা দুই মাস। যদিও বেশিরভাগ বর্ণনাকারী ৫০ দিনের কথাই বলেছেন। বিখ্যাত তাবেয়ি শাবী (রহ.) বলেছেন, আমি যদি সারা বছর রোজা রাখি তবুও ‘সন্দেহের দিন’ রোজা রাখি না। শরিয়েত সন্দেহের দিন বলা হয় আকাশ মেঘলা থাকার কারণে যদি শাবান মাসের শেষ দিন নাকি রমজান মসের পয়লা দিন তা নির্ণয় করা সম্ভব না হয়। শাবি (রহ.) বলেন, আমার ভয় হয় সন্দেহের দিন রোজা রাখার কারণে আমার রোজা খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। খ্রিস্টানদের ওপর যখন মাহে রমজানের রোজা ফরজ করা হয় তখন তারা রোজার আগে পরে একদিন একদিন করে বাড়াতে থাকে। এভাবে এক সময় তাদের রোজার সংখ্যা ৫০ এ গিয়ে ঠেকে।’ (তাফসিরে মাজহারি, ১ম খন্ড, ৩৫৬-৫৭ পৃষ্ঠা। )

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর