বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

নাবিকদের যেভাবে বন্দি করে দস্যুরা

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এমভি আবদুল্লাহর অবস্থান ছিল সোমালিয়ার উপকূল থেকে ২৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে। আজ বৃহস্পতিবার বিকালে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপকূলে পৌঁছার পর জলদস্যু নেতারা বৈঠকে মিলিত হবেন। তারপর তারা মুক্তিপণের জন্য এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষকে ফোন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জলদস্যুরা জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জলদস্যুরা কোনো যোগাযোগ করেনি। আমরা এখন তাদের ফোনের অপেক্ষায় আছি।’ বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যায় এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার উপকূল থেকে ২৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে। বাকি পথ পাড়ি দিয়ে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে উপকূলে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা সার্বিক বিষয় মনিটরিং করছি।’ তিনি বলেন, ‘অতীতের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- জাহাজ জিম্মি করার সঙ্গে সঙ্গে তারা মুক্তিপণ দাবি করে না। জাহাজ উপকূলে নিয়ে যাওয়ার পর জলদস্যু নেতারা বৈঠক করে। তারপর মুক্তিপণ দাবির ফোন দেয়। এ ঘটনার ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে।’ জানা যায়, মঙ্গলবার জাহাজকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর নাবিকদের একটি কেবিনে বন্দি করে রাখে। রাতেই কোনো একসময় জাহাজ নিয়ে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে রওনা দেয় জলদস্যুরা। আজ বাংলাদেশ সময় ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে জাহাজটি উপকূলে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যার দিকে মুক্তিপণের ফোন পেয়েছেন মালিকপক্ষ এমন গুজব উঠলেও তা উড়িয়ে দিয়েছেন কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম।

পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সমাধান করতে চায় : এস আর শিপিং করপোরেশনের আরেকটি জাহাজ ‘এমভি জাহান মনি’ ২০১১ সালের মার্চে সোমালীয় জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ঘটনার ১০০ দিন পর মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজটি জলদস্যুর কবল থেকে মুক্ত হয়। অতীতের অভিজ্ঞতাকে এবার ‘এমভি আবদুল্লাহ’ মুক্ত করার কাজে লাগাতে চায় কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে জলদস্যুরা সেইফ জোনে না যাওয়া পর্যন্ত যোগাযোগ করবে না। আগেও আমাদের এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা এ জাহাজ মুক্ত করতে চেষ্টা করছি।’

যত ভয় কোল্ড কার্গো নিয়ে : জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজে ৫৫ হাজার টন কোল্ড কার্গো আছে। তাপমাত্রার একটু এদিকে-ওদিক হলেই আগুনের আশঙ্কা রয়েছে। এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান শঙ্কার কথা জানিয়ে এক হোয়াটসঅ্যাপের অডিও বার্তায় মালিকপক্ষকে বলেন, ‘আমাদের জাহাজে প্রায় ৫৫ হাজার টন কোল্ড কার্গো আছে। এগুলো বিপজ্জনক। আগুনেরও ঝুঁকি আছে। সর্বশেষ যখন অক্সিজেন পরিমাপ করেছি তখন ৯-১০ শতাংশ লেভেল পেয়েছি। এটি নিয়মিত মনিটরিং করতে হয়। কোনো কারণে অক্সিজেন লেভেল বেড়ে গেলে বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে।’

জাহাজে খাবারে চলবে ২০-২৫ দিন : জলদস্যুদের কবলে পড়া এমভি আবদুল্লাহর খাবার ও পানির মজুত পর্যাপ্ত নেই। মজুত খাবার ও পানি দিয়ে সর্বোচ্চ ২৫ দিন চলবে।

যেভাবে দস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ : এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি করা জলদস্যুরা এক মাস আগে ইরানি একটি ফিশিং বোট জিম্মি করেছিল। মাছ ধরার এ ফিশিং বোট নিয়ে ভারত মহাসাগরে চষে বেড়িয়েছে বড় জাহাজের সন্ধানে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায় তাদের জন্য আসে মোক্ষম সময়। নিজেদের ডেরায় পেয়েই এমভি আবদুল্লাহকে কবজায় নেয় তারা।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান হোয়াটসঅ্যাপের অডিও বার্তায় মালিকপক্ষকে বলেন, ‘আমি চিফ অফিসার বলছিলাম, আবদুল্লাহ জাহাজ থেকে। গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টা) একটা হাই স্পিডবোট আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম দিই। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) দিলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা চলে এলো। তারা ক্যাপ্টেন স্যার ও দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে ঘিরে ফেলল। আমাদের ডাকল। আমরা সবাই এলাম। এ সময় কিছু গোলাগুলি করল। সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসে ছিল। তবে কারও গায়ে হাত দেয়নি। এর কিছুক্ষণ পর একটি বড় ইরানি ফিশিং বোট নিয়ে আরও জলদস্যু চলে আসে। সেই বোটটি এক মাস আগে তারা জিম্মি করেছিল। এটি দিয়ে তারা এক মাস ধরে নতুন কোনো জাহাজ জিম্মি করতে সাগরে ঘোরাঘুরি করছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সামনে পড়ে গেলাম। এখন ওই মাছ ধরার জাহাজ ছেড়ে দেবে। তবে সেটির জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। এখন আমাদের জাহাজ থেকে ডিজেল নিচ্ছে। আমাদের জাহাজটি থামিয়েছে তারা। জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে ভয়ে আছি।’ প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’। জাহাজে ২৩ জন নাবিক রয়েছেন। যাদের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজটি চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং করপোরেশনের। জাহাজটি সাধারণ পণ্য পরিবহন করে।

সর্বশেষ খবর