রপ্তানিযোগ্য পাটপণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বাংলাদেশের পাটের জন্য অপেক্ষা করছে। এসব বাজার খুঁজে বের করে সেখানে দেশের পাটপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে উন্নত ও সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার সম্ভাবনা গতিশীল করতে হবে। গতকাল জাতীয় পাট দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয়টি পাটকল ও ‘বহুমুখী পাটপণ্য মেলা-২০২৪’-এর উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী পাট খাতের উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য ১১ ক্যাটাগরিতে ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং নয়টি পাটসংশ্লিষ্ট সমিতির হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন। পরে তিনি পাটপণ্য মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান মো. আবুল হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। স্বাগত বক্তব্য দেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুর রউফ। কৃষি ও রপ্তানি পণ্য হিসেবে পাটের জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ দেবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেক বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পাটের বহুমুখী উৎপাদন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাট কৃষিপণ্য, আবার শিল্পের কাঁচামাল। রপ্তানিও হয়। এটি কৃষিরও প্রণোদনা পায় না, আবার রপ্তানিরও প্রণোদনা পায় না। আমি পরিবেশবান্ধব এ পণ্যটিকে কৃষিজাত ও রপ্তানিমুখী পণ্যের স্বীকৃতি এবং প্রণোদনা দেব।

উদ্যোক্তা ও দেশ উভয়ের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পাট খাতের যথাযথ যত্ন নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি পাটের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বলছি, আমি একটি সম্পদ আপনাদের কাছে হস্তান্তর করেছি, এর যত্ন নিন। এর সঠিক ব্যবহারে আপনি এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। নতুন ছয়টি পাটকলের ইজারা যারা পেয়েছেন তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনবেন এবং মিলগুলো যৌথভাবে পরিচালনা করবেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক পাটকল অলাভজনক ছিল। সেগুলো বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিয়েছি। সম্পূর্ণ নগদ টাকা হাতে দিইনি। পারিবারিক সঞ্চয় করে দিয়েছিলাম। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে পাটের জন্মরহস্য উন্মোচন করেছেন। আমি তাঁদের সুযোগ করে দিয়েছি। তাতে পাটের গুরুত্ব বেড়েছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার হয়। পাটের ফার্নিচার ও আসবাবপত্র বানানো যায়। গাছের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়েছে। এটি পরিবেশবান্ধব পণ্য হওয়ায় আমাদেরও সুযোগ বেড়েছে। এ পাটশিল্প কীভাবে আরও প্রসার করা যায় তার সুযোগ করে দিয়েছি। পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে পারলে রপ্তানির পথ সুগম হবে।

নতুন খোলা ছয়টি পাটকল, যেগুলো বিজেএমসি দ্বারা ইজারা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো হলো : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কেএফডি জুট মিলস লিমিটেড, নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলস, সিরাজগঞ্জের রায়পুরে জাতীয় জুট মিলস লিমিটেড, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, যশোরের রাজঘাটে কার্পেটিং জুট মিলস লিমিটেড এবং খুলনার খালিশপুরে দৌলতপুর জুট মিলস লিমিটেড।

শেখ হাসিনা বলেন, ২০০২ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। জেডিপিসির মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রায় ৬৫০ জন বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। এ উদ্যোক্তারা প্রায় ২৮২ ধরনের পাটের তৈরি পণ্য বাজারজাত এবং রপ্তানি করছেন। বর্তমানে কাঁচা পাট রপ্তানিতে প্রতি টনে সম্ভাব্য আয় হয় ৭০০-৮০০ ইউএস ডলার, ট্র্যাডিশনাল পাটের সুতা রপ্তানি করে প্রতি টনে সম্ভাব্য আয় ১০০০-১২৫০ ইউএস ডলার, পাটপণ্য রপ্তানি করে প্রতি টনে সম্ভাব্য ২০০০-৩০০০ ইউএস ডলার আর ভেলু অ্যাডেড বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি করে প্রতি টনে সম্ভাব্য ৮০০০-১২০০০ ইউএস ডলার আয় করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, পাটের সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট পণ্যের পাশাপাশি পাট দিয়ে পর্দার কাপড়, কুশনকভার, কার্পেট, শাড়ি তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সঙ্গে মিশ্রণ করা যায়। পাটখড়ি থেকে উন্নতমানের কার্বন তৈরি হচ্ছে। পাটের আঁশ থেকে প্রসাধনী, ওষুধ, রং তৈরি সম্ভব। বাঁশ ও কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাটখড়ি ব্যবহৃত হয়।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা দিয়ে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’ তৈরি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সোনালি ব্যাগের ব্যবহার দ্রুত প্রসারের উদ্যোগ নিতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, শিল্প খাত বিবেচনায় পাটশিল্প এখনো বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। প্রতি বছর কাঁচা পাট, প্রচলিত পাটপণ্য এবং বহুমুখী পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। এ দেশের পাট বিশ্বের অন্যতম নামকরা শিল্পকারখানা বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, টয়োটা, রেনল্ট, ভলভো, অডি, ডেইমলারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯১২ মিলিয়ন ইউএস ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে। পাটের সম্ভাবনা যদি আমরা সম্পূূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে আমাদের রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে যাবে।

১১ ক্যাটাগরিতে সম্মাননা স্মারক পেলেন যারা : পাটবীজ, পাট ও পাটজাত পণ্যের গবেষণায় সেরা গবেষক/বিজ্ঞানী/উদ্ভাবক ক্যাটাগরিতে সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এম এম আলমগীর সাঈদ।

বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী সেরা পুরুষ উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের রাশেদুল করিম মুন্না।

সেরা পাটবীজ উৎপাদনকারী চাষি ক্যাটাগরিতে সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার শাহনুর আলম সান্টু। সেরা পাট উৎপাদনকারী চাষি ক্যাটাগরিতে সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন পাবনার সুজানগরের মো. হারুনুর রশিদ। পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী সেরা পাটকল ক্যাটাগরিতে জনতা জুট মিলস লিমিটেডের পক্ষে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) হেলাল আহমেদ।

পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে রানু অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সুশীল কুমার দাস গ্রহণ করেন সম্মাননা স্মারক। পাটের সুতা উৎপাদনকারী সেরা পাটকল ক্যাটাগরিতে টিমেক্স জুট মিলস লিমিটেডের পক্ষে এমডি তাপস প্রামাণিক সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন। পাটের সুতা রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে আকিজ জুট মিলস লিমিটেডের পক্ষে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন মিলের পরিচালক (অপারেশন) গোলাম মুর্শিদ বাপ্পি। বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী সেরা পাটকল ক্যাটাগরিতে সম্মাননা গ্রহণ করেন করিম জুট স্পিনার্স লিমিটেডের এমডি জাহিদ মিয়া। বহুমুখী পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে ক্লাসিক্যাল হ্যান্ডমেইড প্রোডাক্টস বিডির পক্ষে সম্মাননা স্মারক হাতে পান তৌহিদ বিন আবদুস সালাম।

বহুমুখী পাটজাত পণ্যের সেরা নারী উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে মনির জুট গুডস অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফটসের স্বত্বাধিকারী হাসিনা বেগমের পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন প্রতিষ্ঠানটির সিওও মো. মহিউদ্দিন।